তখনকার বালকগুলো বয়সে ও মননে ‘বালক’ই হতো। আমাদের গল্পের বালকটিও এমনই ছিল। সবকিছুতেই তার প্রশ্ন। সব বিষয়ে ছিল বিস্ময়। আর দু’চোখ ভরা স্বপ্ন।
কাকডাকা ভোরে মায়ের আঁচলতল থেকে মাথা বের করে বিস্ময়ভরা চোখে মায়ের কুরআন তেলাওয়াত করা দেখত। ততদিনে সে আরবি হরফপরিচয় লাভ করেছে। তার কাছে সবচেয়ে বড় বিস্ময় হলো, এই হরফগুলোকে মা কীভাবে একত্র করে অবলীলায় পড়ে যাচ্ছেন। অথচ রোজ রোজ হরফগুলোর নাম মনে করতে তার কত বেগ পেতে হয়।
একসময় বিস্ময়ভরা কণ্ঠে মাকে প্রশ্নই করে বসে। কিন্তু মা কোনো জবাব দেন না। শুধু মিষ্টি করে একটুখানি হাসেন, যেন কোনো রহস্য, বলা যাবে না। বালকের আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। বার বার প্রশ্ন করতে থাকে। একসময় মা তেলাওয়াত থামিয়ে বলেন, মাদরাসায় গেলে তুমিও এমন করে পড়তে পারবে। বালকের কচি হৃদয়ে তখন মাদরাসায় যাবার স্বপ্ন ভর করে।
এরপর কোনো এক শিশিরভেজা ভোরে, ছোট্ট মুঠি দিয়ে বাবার আঙ্গুল ধরে একটি মাদরাসায় এসে উপস্থিত হয়। সে তখনও স্বপ্নের ঘোরে, তার সঙ্গে আছে একটা বিছানা আর মশারি। ছোট্ট একটা ট্রাঙ্কে তেল-সাবান আরও কত কী। সবচেয়ে বড় কথা, সে এখন স্বপ্নের মাদরাসায় আছে। এমন প্রাপ্তির আনন্দে সে বিভোর।
এদিকে কখন যে বাবা বিদায় নিয়ে চলে গিয়েছেন, সে খেয়ালও নেই। একটা বেলা কেটে যেতে হঠাৎ মা-বাবার কথা, ভাই-বোনÑসবার কথা মনে পড়ে। বুকের ভেতর হাহাকার করে ওঠে। কান্নারা উথলে বেরিয়ে আসে। খেতে বসলে মায়ের কথা মনে পড়ে আর দু’গাল বেয়ে অশ্রæ ঝরে। আহ! এখানে গল্প বলে মুখে লোকমা তুলে দেবার মতো কেউ নেই।
কিছুদিন যেতে না যেতে বালকটি এখানেই একটি নতুন পরিবার খুঁজে পায়। পরিবার-প্রধান হলেন উস্তাদ। তিনিই একাধারে মা ও বাবা। তাঁর শাসনকে সবাই যেমন ভয় করে তেমনই তাঁর আদর-¯েœহ পাবার জন্য ব্যাকুল থাকে।
কারও শরীর খারাপ করলে উস্তাদজি যখন পরম মমতায় তার মাথায় পানি ঢেলে দেন, নিজের কৌটা থেকে এটা-ওটা কত কী খাওয়ান, তখন ছেলেটিকে অন্যরা ঈর্ষা করে। এমন মমতা পাবার জন্য ব্যাকুল হয়। বৃহস্পতিবার রাতে উস্তাদজির গল্পের আসরে বসার জন্য ছেলেরা বাসায় যাবার কথাও ভুলে যায়।
এভাবে দিন গড়িয়ে যায়। মাদরাসার এখানে ওখানে দেয়ালের পরতে পরতে স্মৃতিরা সব ঠাঁই পায়। রেহালের আড়ালে চোর-পুলিশ খেলার স্মৃতি কিংবা রাত জেগে পাল্লা দিয়ে পড়া-লেখার স্মৃতি। আরও কত আনন্দ-বেদনার স্মৃতি। সেদিনের ছোট্ট বালকটি এখন হরফের সঙ্গে হরফ জুড়ে পুরোটা কুরআন শরীফ মুখস্থ পড়তে পারে। জবর-জের ছাড়াও আরবি পড়তে পারে। এমনকি অবলীলায় আরবি বলতে পারে। কিন্তু এসব যোগ্যতায় সে বিস্ময় বোধ করে না। বরং অন্যদের বিস্ময় দেখে আনন্দ পায়। বাল্যকালের বিস্ময়বোধের কথা হয়তো তার মনেও নেই। এভাবেই একদিন সে মাদরাসার পাঠ চুকিয়ে পুরোদস্তুর মাওলানা হয়ে বের হয়।
আরও অনেক বছর পর মাদরাসার সেই বারান্দায় একজন মধ্যবয়েসি লোক এসে দাঁড়ান। দৃষ্টি তাঁর উদাস। হাতের মধ্যমা আঙ্গুল মুঠিতে ধরে দাঁড়িয়ে আছে আরেকটি বালক। লোকটি একটি কামরার দিকে ইশারা করে, বালকটিকে শুনিয়ে আবৃত্তি করতে থাকেনÑ‘এইখানে তোর বাপের কবর, জীর্ণ ছাদের তলে’। তখনই কামরা থেকে একটি ছেলে বের হয়ে জানতে চায়, ‘চাচা! কান্দেন ক্যান, কারে চান?’
আগস্ট ২০১৮