সুরের কাছে, সঙ্গীতের কাছে মানুষ আমৃত্যু আকুলভাবে নিবেদিত। এ নিবেদন ঐচ্ছিক নয়, সৃষ্টিগত। সুরের প্রতি মানুষের এই ব্যাকুলতা কখন থেকে শুরু হয়, কেউ সঠিক করে বলতে পারবে না। চিকিৎসাশাস্ত্রের ভাষ্যানুযায়ী, গর্ভস্থ শিশুও সুরের আহŸানে সাড়া দেয়। যে শিশুটি জন্মের পর কান্নায় ভরে তোলে ফিনাইলের গন্ধমিশ্রিত হাসপাতালের করিডোর, কিংবা দমবন্ধ অন্ধকার ঘরের চারপাশ, বাতাসের ইথারে যখন ছড়িয়ে পড়ে তার ঈষৎ কান্নার অনুরণন, একজন পিতার কাছে সেই কান্নাকে মনে হয় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুরশিল্প। পৃথিবীর তাবৎ সুর নস্যি হয়ে যায় এই কান্নার কাছে। মায়ের দশমাসের বিভীষিকাময় মুহূর্তকে মুহূর্তেই চৌচির করে দেয় সেই কান্নার ঢেউ। তার চোখে ঝলমলিয়ে ওঠে বহুকাক্সিক্ষত এক রৌদ্রকরোজ্জ্বল ভুবন।
চলতে চলতে মানুষ কখন, কতোভাবে যে আটকে যায় ছন্দময় পৃথিবীর বহুমাত্রিক সুরইন্দ্রজালে। বহুবিধ সুরের ছড়াছড়ি তার মগজে গেঁথে দেয় সুরপ্রাচুর্যে ভরপুর অনন্য এক পৃথিবী। যা সে আগলে রাখে পরম মমতায়। আনন্দে-বিষাদে-একাকিত্বে-সাধনায়-প্রার্থনায় মানুষ ডুবে যায় তার সুরের নিজস্ব নিসর্গে। চোখের পলক পড়ার নৈপুণ্যে, প্রতিটি পদবিক্ষেপে গ্রথিত হয় ছন্দের খেলা। টিনের চালে হুড়মুড় করে নেমে আসা বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটার শব্দ, সে এক নির্মাণ-অসাধ্য সঙ্গীত। পাখির কণ্ঠছেঁড়া সুরের জাদুময়তার কাছে নতজানু পড়ে থাকে হৃদয়ের সমস্ত নিবেদন। ঢেউয়ের ভায়োলিনে জন্ম নেওয়া সমুদ্রের শোঁ শোঁ গর্জন, সে-ও তো সমুদ্রের বক্ষছেঁড়া সঙ্গীত। ঝরণার নিটোল নৃত্যের ঝঙ্কারে জেগে ওঠে পাথরের অকোমল দেহাবয়ব। টুকরো টুকরো পাথরের জলা জড়িয়ে যখন গড়িয়ে যায় জলের জাহ্নবী, পৃথিবীতে কে আঁকতে পারবে ছন্দ ও সঙ্গীতের এমন দৃষ্টপট?
প্রকৃতির এ সমস্ত উপাদান থেকে মানুষ মগজে গেঁথে নেয় ছন্দের ছলাকলা। কণ্ঠে বেঁধে নেয় সুরের চাতুর্য। দু’য়ের সমন্বয়ে নির্মাণ করে ¯্রফে অনুভব্য, ব্যাখ্যা-সুদূর এক সঙ্গীতরাজ্য।
পৃথিবীতে এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর, যে কখনো দু’য়েক ছত্র ছন্দ মেলায়নি আনমনে। যে কখনো গুনগুন করে গায়নি গানের কোনো একটি অংশ। সুরের মাদকতায় কখনো নিজেকে সমর্পণ করেনি, এমন মানুষ পৃথিবীতে বিরল নয়, নেই-ই।
জীবনের গøানিময় বোঝা বইতে বইতে ক্লান্ত হয়ে-যাওয়া ব্যক্তির জন্য সঙ্গীত এক পরম আশ্রয়। বিষাদগ্রস্ত হলে মানুষ ফিরে যায় সঙ্গীতের কাছেই। আনন্দেও কাছে চাই সঙ্গীত। মোটকথা, সঙ্গীত তার বহুমাত্রিক ডালপালার ছায়া বিস্তৃত করে রাখে মানুষের জীবনের বৈচিত্র্যপূর্ণ অনুষঙ্গে। তাই, সুখে-দুঃখে, বিরহে-বিনোদনে মানুষ আর সঙ্গীত হৃদ্যতার সূত্রে আবদ্ধ।
কথা হলোÑ মানুষের গøানি দূরীকরণ বা চিত্তবিনোদন পর্যন্তই কি সঙ্গীতের প্রভাব সীমাবদ্ধ? অবশ্যই না। সঙ্গীতের প্রভাব জীবনের এরচে’ও গভীরে, এরচে’ও সূ² স্তরে।
সঙ্গীত মননকে শান্ত করে। হৃদয়কে পরিশীলিত করে। আত্মাকে দান করে অপরিমেয় প্রশান্তি। পৃথিবীর সুরসাধক এবং গান-রচয়িতারা স্থানে স্থানে গেঁথে গেছেন এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ছন্দের চাতুর্য আর সুরের সৌকর্য দিয়ে বিপ্লব ঘটিয়েছেন মানুষের মগজে-মননে।
ইতিহাসের খেরোখাতায় জ্বলজ্বল করে জ্বলা এইসব প্রবাদপ্রতিম সঙ্গীতজ্ঞদের একজন পাকিস্তানের জুনায়েদ জামশেদ। যিনি সুরের মমতা দিয়ে অনুভবের গভীরতর তন্ত্রীতে আলোড়ন তুলেছেন বারবার। সুরের মোহজালে বেঁধে যিনি শ্রোতাকে নিয়ে গেছেন দূরানুভব্য এক অলৌকিক জগতে। কথার বাঁকে-বাঁকে খুঁজে ফিরেছেন জীবনের প্রকৃত অর্থ। সুরের নজরানা দিয়ে নিজেকে সমর্পণ করেছেন ¯্রষ্টার সমীপে। প্রার্থনার অনুতপ্ত হাতে বারবার তুলে এনেছেন অতীতের পঙ্কিল পদচিহ্ন। ছন্দোবদ্ধ বাণীর পাঁজরে সুরের প্রলেপ মেখে বুঝিয়ে দিয়েছেন, সঙ্গীত শুধু চিত্তবিনোদক কিংবা কণ্ঠের কুহক নয়, সঙ্গীত এক পরম ইবাদত। নিজেকে প্রিয়তমের দরবারে সঁপে দেওয়ার জন্য সঙ্গীত এক অনবদ্য আশ্রয়। প্রিয়ের সান্নিধ্য অর্জনের জন্য সুর এক অফেরতযোগ্য অনুনয়। পরমাদৃত পায়ে অর্পণের জন্য সুরও হতে পারে এক অনন্য উপহার।
তার গানে প্রেম ও বিরহ প্রশংসার নিক্তিতে সমানুপাতিক। যেমন রয়েছে মহাদিনে প্রশংসিত পরিণামের প্রত্যাশা, তেমনই রয়েছে কঠোর শাস্তির শঙ্কাবোধ। কুরআনের ভাষ্যমতে যা মুমিনের গুণাবলিকে নির্দেশ করে। জুনায়েদের কণ্ঠে যখন বাজেÑ ‘সুনো মে নাম তেরা ধারকানো মে/ মজা আ-জায়ে মাওলা দিল বদল দে…’, তখন সেটা সুর আর সঙ্গীতের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত প্রেমের উপাখ্যান। অনুনয়টুকু জীবন্ত মাছের মতো সাঁতরাতে থাকে আকাক্সক্ষার মোহন জলে।
সেই অনুনয়ে অনন্য মাত্রা যোগ হয়, যখন তিনি পরবর্তী পঙক্তিতে সুরের মমতা ঢালেনÑ ‘হঠা লো আঁখ আপনি মা ছিওয়া ছে/ জিয়োঁ ম্যায় তেরি খাতির দিল বদল দে…’। প্রেমের জন্য ত্যাগ এক সাধারণ বিষয়। কিন্তু সেই সাধারণ বিষয় অসাধারণ হয়ে ওঠে আবেদনের অকৃত্রিমতা এবং চাওয়ার স্বল্পতায়Ñ ‘কারো কুরবান আপনি সারি খুশিয়াঁ/ তু আপনা গাম আতা কার দিল বদল দে…’।
প্রেমের পরিপূর্ণতা তখনই, যখন মিলে যায় প্রেমিকের কাক্সিক্ষত সাক্ষাত। জুনায়েদের কাতরকণ্ঠে যখন ঝরে পড়ে সে সাক্ষাতের ব্যাকুলতাÑ ‘তেরা হো জাও ইতনি আরজুঁ হ্যায়/ বাস ইতনি হ্যায় তামান্না দিল বদল দে…’ তখন জুনায়েদকে অতিক্রম করে আমরা হয়ে যাই সে প্রেমাস্পদের সাক্ষাতার্থী। মনে হয়, এ তো আমারই মনের সুপ্ত গুঞ্জরণ! এ তো আমারই বহুজনমের প্রার্থনা! এভাবে সঙ্গীতে জুনায়েদ আবৃত্তি করে চলেন আমাদের হৃদয়ের গহীনতম পঙক্তিসমূহ। আমাদের কামনা-প্রার্থনাগুলো তিনি নিজের মতো করে সাজিয়ে দেন সুরের ডালিতে। তাই, জুনায়েদের সুরগুলো আর তার থাকে না, হয়ে ওঠে আমাদের আত্মার অনুরণন। নিজেকে অতিক্রম করে তিনি ছড়িয়ে পড়েন হৃদয় থেকে হৃদয়ে। হয়ে ওঠেন আমাদের প্রেমার্থী আত্মার প্রতিবিম্ব।
জুনায়েদের সঙ্গীতের সিংহভাগজুড়েই রয়েছে অনুতাপ ও পাপবোধ। শিল্পের মান বিচারে শিল্পীর ব্যক্তিজীবন আলোচনায় মুখ্য না-হলেও জুনায়েদ এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমীদের দলভুক্ত বলে মনে হয়। তার হঠাৎ মোড়ফেরা জীবন গভীর ছায়া ফেলেছে সঙ্গীতের আদ্যোপান্তে। জুনায়েদপ্রেমীমাত্রই জানেন তার অতীত জীবনের উপাখ্যান। আড়ম্বর, প্রাচুর্যপূর্ণ আর রঙিন জীবনের দৃশ্যপট ছেড়ে সাদাসিধে ও নিষ্কলুষ জীবনে ফিরে আসা ব্যক্তির সংখ্যা ইতিহাসে দুর্লভ না হলেও খুব বেশি নয়। জুনায়েদ সেসব সৌভাগ্যবানদের একজন।
মিউজিকের মায়াজাল আর লালচে জল ও আলোর মোহগ্রস্ততা উপেক্ষা করে, তুমুল জনপ্রিয়তার শেকল ছিঁড়ে তিনি ফিরে এসেছেন স্বচ্ছ আলোর পৃথিবীতে। এই বিপ্লব তার জীবনে এনে দিয়েছে তুমুল পরিবর্তন।
তিনি পেছনে ফিরে দেখেছেন, জীবনের ফলপ্রসূ সময়টুকু আটকে গেছে পঙ্কিলতার ফাঁদে। ঝড়বিধ্বস্ত পাখির ডানা থেকে যেমন মুছে যায় উড়ার উচ্ছলতা। তার পালকের পরতে গুঁজে যায় বিষাদ আর ভয়, তেমনি জুনায়েদের বাঁক নেয়া জীবনেও অতীতের পাপবোধ দাগ কেটেছিলো গভীরভাবে। সেই অনুশোচনা তাকে শাসন করেছে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত। এই অনুতাপগ্রস্ততা আর অপরাধবোধ গভীরভাবে ফুটে উঠেছে তার প্রার্থনামূলক সঙ্গীতগুলোতে। তার কণ্ঠের গাম্ভীর্য আমাদেরকে সেই ঝড়বিধ্বস্ত পাখিটির কথাই মনে করিয়ে দেয় বারবার। আল্লামা তকি উসমানির লিরিকে গাওয়া তারÑ ‘ইলাহি তেরি চৌকাঠ পার, ভিখারি বান কে আয়া হো…’ আদ্যোপান্তই এক অপরাধীর আত্মোপলব্ধি।
নাতের দহলিজেও জুনায়েদ সুরের স্বাতন্ত্র্য নিয়ে সমুপস্থিত। হৃদয়ের গহীনটা ছেনে তিনি তুলে এনেছেন রাসুলপ্রেমের আক্ষরিক সোনাদানা। সেগুলোকে ভিজিয়েছেন আবেগ আর মমতার সুরজ জলে। তার ঠোঁটের বাঁধন গলে যখন বেরিয়ে আসে একেকটি সুরেভেজা হরফ, মনে হয় হৃদয় ছিঁড়েখুঁড়ে তিনি বের করে আনছেন একেকটি প্রেমের পদ্ম। সুরগুলো জীবন্ত হয়ে ওঠে নবীপ্রেমের অকৃত্রিম ছোঁয়ায়। মনে হয় ক্রমশ নিকটে আসছে ‘মুহাম্মদ কা রাওজা’। আমাদের হৃদয় মুহূর্তেই উদ্বেলিত হয়ে ওঠে প্রেমের প্রশংসিত পরশে। জুনায়েদ যখন গেয়ে ওঠেনÑ‘ফরিশতা ইয়ে দে দো পয়গাম উনকো/ খবর যা কে দে দো উনকো ফরিশতো/ কে খাদিম তুমহারা সাঈদ আ-রাহা হ্যায়…’ তখন কেউ আর নিজেকে নিজের অবস্থানে ধরে রাখতে পারি না। আমাদের চোখে ভেসে ওঠে সবুজ গম্বুজ। ভেসে ওঠে রওজা পাকের প্রশান্তিময় দৃশ্য। ভেসে ওঠে মদিনার বালি ভেঙে এগিয়ে চলা একদল চাতক প্রেমিকের অবসাদহীন সন্তরণ। এখানে এসেই সঙ্গীত আর প্রাণ একাকার হয়ে যায়। এখানে এসেই সঙ্গীত হয়ে ওঠে ইবাদত।
পরশ পাথরের ছোঁয়ায় লোহাও স্বর্ণ হয়ে ওঠে। তেমনি হৃদয়ের ঐশ্বর্য ঢেলে সুরারোপ করলে সাধারণ কথাও হয়ে ওঠে পরমাদৃত। উদাহরণÑ ‘মিঠা মিঠা পেয়ারা পেয়ারা মেরে মুহাম্মদ কা নাম/ হাম সব ভেজে উন পে হাজারোঁ সালাম…’।
জুনায়েদ নিটোল সুরে বাংলা নাতও গেয়েছেন। তার ‘নবি মোর পরশমণি/ নবি মোর সোনার খনি’র গায়কী এতোটা চমৎকার ও নিখুঁত যে, তাকে বাংলাভাষী বলে যে কারও ভ্রম হতে পারে।
সঙ্গীতকার হিসেবে তিনি কতোটুকু সার্থক, এখান থেকে তা কিছুটা উপলব্ধি করা যায়। সহজ ও খোলা কণ্ঠে গেয়েছেনÑ ‘হে রাসুল, বুঝি না আমি/ রেখেছো বেঁধে মোরে কোন সুতোয় তুমি/ রেখেছো বেঁধে মোরে কোন সুতোয়…’ গানটিকে তিনি শ্রোতার হৃদয়ের যে পরিমাণ গহীনে নিয়ে যেতে পেরেছেন, হলফ করে বলতে পারি, অন্য কেউ পারেননি।
ফি বছর রিলিজ হয়েছে তার নতুন গানÑ ‘ম্যায় তো উম্মাতি হো ইয়ে শাহে উমাম/ কার দে মেরে আকা আব নজরে কারাম…’। শিল্পমাধুর্যে ভরপুর কথামালা আর অকৃত্রিম মমতা মাখানো গায়কীর কারণে গানটি মুহূর্তেই ভালোবাসার আসন গ্রহণ করে কোটি হৃদয়ে। বরাবরের মতো এ গানেও জুনায়েদ স্বাতন্ত্র্যে সমুজ্জ্বল।
সর্বশেষ দু’ হাজার ষোলো’র সাত ডিসেম্বর গানের এ দিকপাল এক বিমান দুর্ঘটনায় অন্তিম দাড়ি টানেন নশ্বর এ পৃথিবীর সকল দৃশ্যায়নে। তার মহাপ্রয়াণে নজরুলের গানের একটি শ্লোক বারবার ফিরে এসেছে মগজের নিউরনে– ‘আমায় নহে গো ভালোবাসো শুধু/ ভালোবাসো মোর গান,/ বনের পাখিরে কে চিনে রাখে/ গান হলে অবসান…’।
মৃত্যুই সর্বশেষ কথা নয়। ক্ষণজন্মা মানব মহাকালের বনে হারিয়ে গেলেও সুরের মানব থেকে যাবেন পাঁজরের মায়াবী অলিন্দে। ছন্দে-সুরে জুনায়েদ আমরণ বেঁচে থাকবেন আমাদের হৃদয়ে। হৃদয়ে সাজানো ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার ডালিতে সবচে’ বড়ো গোলাপ হয়ে তিনি সুরভী ছড়াবেন বিশ্বাসের পবিত্র উদ্যানে।
মুহাম্মাদ রাইহান তরুণ কবি ও গীতিকার, সিলেট
জানুয়ারি, ২০১৭ সংখ্যায় প্রকাশিত