অদূর আড়াল থেকে একটা দু’টা গুলি আসছে। ঠাস ঠাস করে কখনো খালি জায়গায় পড়ছে কখনো বিদ্ধ হচ্ছে মানুষের ভিড়ে।
ফিলিস্তিনের সীমান্ত। বালুকাময় উষ্ণভূমি। বালু খুঁড়ে ধুলো উড়িয়ে ট্যাঙ্কগুলো তুফানের মতো তীব্র গতিতে আসছে। ক্রমে অভিযানের
মাত্রা আরেকটু বাড়ে। সিন্দুকের আকারে কোনো এক যুদ্ধযান থেকে ইটের ভাটার ন্যায় দূষিত কালো ধোঁয়া উর্ধ্বে উড়ছে। ট্যাফে ট্রাক্টরের আওয়াজের মতো গট গট শব্দ ক্রমেই বাড়ছে। যুদ্ধযানগুলো তিল তিল করে সামনে এগুচ্ছে। উদ্দেশ্য একটাইÑমসজিদ প্রাঙ্গন।
বিশাল মসজিদ। যেখানে সব মিলিয়ে ৫ লক্ষ মানুষ একসাথে নামাজ পড়তে পারে। নানান সজ্জায় সজ্জিত মসজিদটি। পাথরের গায়ে খোদাই করা হস্তশিল্প। পাশে রয়েছে অগণিত পরমাত্মা আম্বিয়া আলায়হিমুস সালামের কবর। যেন জান্নাতের টুকরো। নিবিষ্ট মনে তাকালে চক্ষু শীতল হয়ে আসে। অন্তরে নামে প্রশান্তির আবহ। অনায়াসে মনে জাগ্রত হয় দু’রাকাত নামাজ পড়ার আগ্রহ। এক সময় এটি ছিলো অনন্য সৃজনশৈলীতে নির্মিত বিশ্বের অন্যতম স্থাপনার একটি । সীডরসহ দুষ্প্রাপ্য সব গাছের দশ হাজার কাঠের টুকরো, হাতির দাঁত আর ঝিনুকের মিশ্রণে এক ফোঁটা আঠা কিংবা কোনো তারকাটার ব্যবহার ছাড়াই এটি তৈরি করা হয়েছিল আশ্চর্য এক কুশলতায়। পুরো পৃথিবী জুড়ে যার দৃষ্টান্ত ছিল বিরল। ইসরায়েলিরা এসব স্থাপত্য ধ্বংস করলেও একবার তাকালে চোখ পড়ে থাকে ওখানে। কারণ, এই মসজিদে এক রাকাত নামাজ পড়লে পঞ্চাশ হাজার রাকাত নামাজের সওয়াব পাওয়া যায়। এই মসজিদ নবিদের মসজিদ। মানুষের হাতে গড়া পৃথিবীর প্রথম মসজিদ। সকল নবি আলায়হিস সালাম এই মসজিদে তাশরীফ এনেছেন। মেরাজের রজনীতে সমস্ত নবি-রাসুল এখানে জড়ো হয়েছিলেন। মহানবি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাঁদের ইমামতি করেছিলেন।
মাসজিদুল আকসায় দুরাকাত নামাজ পড়ে হৃদয়কে প্রশান্তকরার জন্য বাংলাদেশ থেকে গেলেন তরুণ এক কাফেলা। সীমান্তে যেতেই চোখ পড়ল ফিলিস্তিনের নিরীহ মুসলিমদের ওপর। সবাই ছোটাছুটি করছে। দম ফেলবার মতো স্বস্তি নেই। মুসলমানের চিরশত্রæ ইসরায়েলি ইহুদিরা গোলা-বারুদ ছোঁড়ে ধোঁয়াটে করে রেখেছে পুরো এলাকা। আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হচ্ছে বোম্বিংয়ের কানফাটা আওয়াজে। নিরীহ মুসলিমরা কোনোমতে জড়ো হয়েছে আকসা মসজিদে। তবু রক্ষা নেই। আতঙ্ক বিরাজ করছে চারিদিকে, কখন জানি কী হয়!
ফিলিস্তিনের কয়েকটটি পাথর-শিশু খেলছিল মাঠে। তাদের চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ থাকলেও হরদম রোষানলে দগ্ধ হয় কচি হৃদয়। ইহুদি হায়েনাদের শেষ করতে এরা বুক-পকেটে ত্রিভুজ পাথর নিয়ে বেড়ায়। পৃথিবীর আলো দেখার সাথে সাথে এরা পরিচিত হয় গোলা বারুদের সাথে। স্বাভাবিক খাদ্যগ্রহণের উপযোগী হওয়ার সাথে সাথে এরা পরিচিত হয় বন্দুকের নলের সাথে। মুখ ফুটে কথা শেখার আগেই কানের পর্দা ঝালাই করে মিসাইলের করুণ-কপট আওয়াজে।
খেলার মাঠের অনতিদূরেই সীমান্ত এলাকা। দুইটা ইসরায়েলি সৈন্য টহল দিচ্ছে এখানে। হাতে বন্দুক। পরনে মিলিটারি ইউনিফর্ম। মাথায় হেলম্যাট। ফিলিস্তিনের পাথর-শিশুরা এসব দেখে অভ্যস্ত। তারা এসব ভয় পায় না। ঘৃণায় ভরা প্রতিশোধের ঝলঝল চোখ দিয়ে ইসরায়েলিদের প্রতি বিস্ফোরণ করে ছুটে চললো সীমান্তে আগত বাংলাদেশি মুসলিম ভাইদের অভ্যর্থনা জানাতে। এর আগেও বাংলাদেশি প্রায় ৮ হাজার তরুণ গিয়েছিল ফিলিস্তিনে। ‘প্যালেস্টাইনিয়ান লিবারেশন অর্গানাইজেশন’ বা ‘ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা’র হয়ে লড়াইয়ে তারা অংশগ্রহণ করেছিল। এমনকি ১৯৮২ সালের ২২ জুলাই বাংলাদেশি তরুণ কামাল মুস্তাফা আলি ফিলিস্তিনের হয়ে দক্ষিণ লেবাননের নাবাতিয়া এলাকায় অবস্থিত ‘হিগ রক দূর্গে’ ইসরায়েলিদের হাতে শহিদ হন।
ফিলিস্তিনের এই শিশুরা তাদের বাবা-মার কাছে শুনেছে বাংলাদেশি বীর শহিদ কামাল মুস্তাফা আলির সাহসী যুদ্ধের কথা। শাতিলা রিফিউজি ক্যাম্পের অদূরে একটা কবরস্থান। ১৯৭০ সাল থেকে শহিদ হয়ে আসা ফিলিস্তিনি মুক্তি সংগ্রামের শহিদদের সমাধি এখানে। বিদেশি যুদ্ধাদের পাশে শহিদ কামাল মুস্তাফা আলি ‘বাংলাদেশ’ লেখা কবর ফলকের সাথেও এরা পরিচিত। মাঝে-মধ্যে শহিদ হওয়া আত্মীয়ের কবর জিয়ারত করতে এসে নামটি মুখস্ত করে নেয় এই মুক্তিকামী অবুঝ শিশুরা। তখন থেকেই বাঙালিদের প্রতি আলাদা একটা শ্রদ্ধা। আবেগ আর ভালোবাসা। এবার বাংলাদেশি ভাইদের আসার খবর পেয়ে তারা বেশ উৎফুল্ল।
কেম্নে কী করে ইসরায়েলিদের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাঙালি তরুণদের সাথে নিয়ে সীমান্তের ভেতরে চলল শিশুগুলো। বাঙালিরা ধোঁয়াটে করুণ পরিবেশে বিচলিত না হয়ে আকসার তামান্নায় ছুটে চললেন শিশুদের সাথে। মুসলিম বাঙালি ভাইদের পেয়ে ফিলিস্তিনিরা শোকের মাঝেও আত্মহারা। মুসলিমরা তো একদেহ এক প্রাণের মতোই।
শূন্য হাতে মুসলমানরা। পাল্টা আক্রমণের বাহ্যিক কোনো অস্ত্র তাদের নেই।
মসজিদের ভেতর ছটফট করছি আমি। আমার মতো একই অবস্থা বাঙালি ক’জনসহ ফিলিস্তিনের আরো অনেক বাসিন্দার। বাইরে আসা-যাওয়া করছে ইসরায়েলি সৈন্যরা। কাঁধে শর্টগান ঝুলানো আর পকেটে বুলেট চাপানো সৈন্যদের ঝাঁকড়া ড্রেস দেখে বারবার শিউরে উঠছি।
আক্রমণটা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। ঘন বৃষ্টির মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আসা গুলিগুলো তাজা তাজা প্রাণ নিমিষেই শেষ করছে। হায়, পিচাশের দলের কি একটুও দরদ লাগে না!
চোখের সামনে এ রকম নির্মম মৃত্যু দেখে নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না। ভয়ে তর তর কাঁপছে আমার গোটা শরীর। গায়ের লোমগুলো বাবলা গাছের কাঁটার মতো খাড়া হয়ে আছে। চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ। জীবনের সঞ্চিত সব সাহস আজ হারিয়ে ফেলেছি। কালেমা-ইসতেগফার পড়ছি। কখন জানি ঝাঁঝালো গুলি এসে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় আমাকে শহিদানের কাতারে…।
দুই
এমনই একটি স্বপ্নে বিভোর ছিলাম আমি। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়াটা উদ্ধার করেছে আমাকে ইসরায়েলি হায়েনার কবল থেকে।
তখনও বিছানায় গা এলানো, তন্দ্রা এখনো মিজ মিজ করছে চোখে-মুখে। নিথর পড়ে আছি ভাবনার সাগরে। ভাবছি, স্বপ্নের ভেতরই যদি আমি এতটা ভয় পাই এমন পরিস্থিতি, তবে বাস্তবে ফিলিস্তিনের মুসলমানরা কেম্নে সয়ে যাচ্ছে যুগের পর যুগ ধরে! আল্লাহ, ফিলিস্তিনের ওপর তুমি রহম কর!
নবধ্বনি, ফেব্রুয়ারি ২০১৮ সংখ্যায় প্রকাশিত