পৃথিবীকে আজ অন্যরকম দেখাচ্ছে। মানুষের হাসি-খুশি আর আনন্দ-রবে মেতে উঠেছে নীরব প্রকৃতিও। মদিনার অলিতে-গলিতে ছিটকে পড়ছে খুশির ঝিলিক। আকাশে-বাতাসে শব্দিত হচ্ছে স্বর্গীয় উৎসবের অনিন্দ্য কোলাহল। কারণ, আজ ইদের দিন। ত্যাগ-তিতিক্ষা, সাধ ও সাধনার স্মৃতি বিজড়িত দিন। আনন্দপ্রকাশ ও আত্মোৎসর্গের দিন। বরকত ও কল্যাণের দিন। আজ এক ও একত্র হওয়ার দিন। তাই খুব ভোরে প্রাতস্নান সেরে নতুন জামায় সুগন্ধ-সৌরভ ছড়িয়ে ছোট-বড় সকলেই আল্লাহু আকবার শ্লোগানে ছুটে চলছে ঈদগাহ পানে।
আমাদের প্রিয়নবিও তাঁর রীতিমাফিক মন্থর গতিতে হেঁটে চলছেন। সহসা তাঁর চোখ পড়লো পথকোণে দাঁড়িয়ে হৃদয় ভেঙে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকা নিষ্পাপ এক শিশুর ওপর। নবিজি সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বড়দের যেমন খুব সম্মান করতেন তেমনি ছোটদেরও ভালোবাসতেন সীমাহীন । বর্ণিত আছেÑ নবিজি যখন নামাজে সিজদায় যেতেন তখন তাঁর আদরের নাতিরা কাঁধে চড়ে বসতো। তাঁর কোলে বসে দাড়ি নিয়ে খেলা করত। তিনি তাদের শিশুসুলভ এমন আচরণে মুগ্ধ হতেন। মুচকি হেসে তাদের কাজকে সমর্থন করতেন। ইচ্ছেমতো তাদের খেলতে দিতেন। শিশুপ্রেমী নবিজি কী করে শিশুটির কান্না দেখেও না দেখার ভান করে ঈদগাহে চলে যাবেন? শিশুটির রোদনমাখা নিষ্পাপ বদন-ছবি হৃদয়ে গেঁথে তিনি কিভাবে ঈদের নামাজ পড়াবেন? ভালোবাসার নির্মেঘ আকাশের কণ্ঠে কী করে ধ্বনিত হবে খুতবা-বাণী?
আনন্দময় এই দিনে নাবালক শিশুটিকে পথধারে দাঁড়িয়ে এভাবে কাঁদতে দেখে নবিজির হৃদয়-আকাশে মেঘ জমে ওঠে। শুরু হয় বিষাদানলের ধারাবর্ষণ। নবিজি তার কাছে গেলেন। স্নেহের পবিত্র হাতখানি মাথায় বুলালেন। অতিকোমল স্বরে তার পরিচয় জানতে চাইলেন। প্রিয়নবির অবিভাবকসুলভ জিজ্ঞাসায় শিশুটি কান্নামেশানো কণ্ঠে উত্তর দিলÑ আমার পৃথিবী শূন্য। বাবা-মা কেউ নেই! অসহায় শিশুটির কান্নাজড়িতকণ্ঠে দুঃখমাখা ক্ষুদ্রজীবনের অণুগল্প শোনে প্রেম-ভালোবাসার অকূল দরিয়া প্রিয়নবি তাকে সাান্ত¦না দিয়ে বললেনÑ কে বলেছে তোমার পৃথিবীতে কেউ নেই? চলো, আমার সাথে চলো। নবিজি তাকে বাড়ি নিয়ে গেলেন। তাঁর প্রিয়তমা হজরত আয়েশা রাযি.-এর দিকে ইশারা করে বললেনÑ আজ থেকে ইনি হলেন তোমার মা আর আমি বাবা। যাও তোমার মায়ের কোলে যাও। হজরত আয়েশা রাযি. প্রিয়তম নবিজিকে মুচকি হাসি বিনিময় দিয়ে শিশুটিকে কোলে তুলে নেন। পরম মমতায় বুকে জড়িয়ে কপালে এঁকে দেন মাতৃস্নেহের চুমু।
মা আয়েশার কোলে বসে বাবা মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের নুরানি চেহারার দিকে তাকাতেই শিশুটি ভুলে যায় তার মা-বাবা হারানোর অনল স্মৃতি। অতঃপর হজরত আয়েশা রাযি. তাকে গোসল করিয়ে খুশবুমাখা নতুন জামা পরালেন। এবার সেও নবিজির হাতধরে হাসিমুখে ছুটলো ঈদগাহপানে। প্রিয়নবির উপমাহীন ভালোবাসায় সে আবারও ফিরে পেলো তার স্বপ্নের পৃথিবী।
নবধ্বনি, জানুয়ারি ২০১৮ সংখ্যায় প্রকাশিত