আজকাল আমরা চিঠি লিখি না কথাটা বললে নিশ্চয়ই ভুল হবে। দিনে রাতে অগণিত চিঠি আমরা পড়ি এবং লিখি। সকালে বাসা থেকে বের হয়ে বন্ধুকে লিখি দোস্ত, বের হয়েছি। সময়মত চলে আসিস। কাজের সময় নানা চিঠি লিখি প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে। সন্ধ্যার বাসায় ফেরার সময় কী কী কিনতে হবে তার লিস্টও চিঠিতে লিখে জানিয়ে দেয় ঘরের মানুষ। বলতে গেলে আমাদের এই চিঠিগুলো লেখার কোনো সময়-ক্ষণ নেই। যখন তখন চিঠি আসে। আমরাও ঝটপট তার উত্তর পাঠিয়ে দেই।
দৈনন্দিন আমাদের এই চিঠি লেখার কোনো নিয়ম-কানুন নেই। বোঝার মত করে লিখে সেন্ড বাটনে চাপ দিয়ে চোখের পলক ফেলার আগেই পৌঁছে দেই অপর প্রান্তে। ভাষা-ব্যকরণ এমনকি অক্ষরের বালাই নেই। হয়ত এই সহজতার জন্যই আমাদের এত চিঠি লেখা। না হয় আজ থেকে পনেরো-ষোলো বছর আগের কথা যদি মনে করি তাহলে বেশ অবাক লাগে। প্রিয়জনদের চিঠি আসার সংবাদে যেভাবে মন পুলকিত হত সে পুলকের এক বিন্দুও কি লাগে এখনকার মেসেজের টুং টাং শব্দে?
আজকাল চিঠি লেখাটাই হয় শুধু। সেটা মোবাইলের ক্ষুদে বার্তা হোক অথবা মেসেঞ্জারের মেসেজ কিংবা অফিসিয়াল ইমেইল হোক। চিঠি পাঠানো নিয়ে চিন্তা, তার জন্য কষ্ট করে হেঁটে ডাকঘরে যাওয়া অথবা চিঠি পাঠানোর পর উত্তরের জন্য অপেক্ষা কোনোটিই আমাদের করতে হয় না। চিঠি নামক এই আদান-প্রদান মাধ্যমের একটা ক্ষুদ্র অস্তিত্বই আমরা এখন বাঁচিয়ে রেখেছি বলা যায়। তবে একটু পেছন ফিরে তাকালেই দেখা যায়, চিঠির সাথে জড়িয়ে আছে ডাকঘর, ডাকবাক্স এবং ডাকপিয়ন। শত বছর ধরে মানুষের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখের সংবাদ, আবেগ-অনুভূতি সবকিছু বিশ্বস্তভাবে বহন করে এসেছে এই তিনটি উপাদান। ডাকপিয়ন হয়ে ওঠেছে মানুষের সুখ-দুঃখের বার্তাবাহক। বাড়ির সামনে ডাকপিয়নকে দেখে দৌড়ে এসেছে মানুষ। এই বুঝি এলো প্রিয়জনের চিঠি। ডাকপিয়নের ত্যাগের কথা মনে করে কবি সুকান্ত লিখেছিলেন তার বিখ্যাত রানার কবিতাটি।
ডাকব্যবস্থা চলে আসছে প্রাচীনকাল থেকে। রোম ও পারস্যের সাম্রাজ্যে সম্রাটের পক্ষ থেকে বিশেষ বাহিনী পৌঁছে দিত রাজকীয় বার্তা। ইসলামি রাষ্ট্রে দাপ্তরিকভাবে ডাকব্যবস্থা গড়ে ওঠে উমাইয়া শাসনামলে। অর্ধেক পৃথিবী বিস্তৃত ইসলামি খেলাফতের নানা ফরমান পৌঁছানো হত ডাকব্যবস্থায়। সেসময়ে নানা উপায়ে পৌঁছানো হত চিঠি। ইতিহাস ঘাটলে তার কিছু বিবরণ আমরা পাই।
কবুতর
কবুতরের মাধ্যমে চিঠি পাঠানোর কথা শোনা যায় আড়াই হাজার বছর আগের রোমান সম্রাজ্যে। কুরআন থেকে আমরা সুলাইমান আলাইহিস সালামের হুদহুদের কথা জানি। ইসলামি যুগে বিশেষ করে মিশরের মামলুক সাম্রাজ্যেও সরকারি বার্তা পাঠাতে ব্যবহার হত কবুতর। শুনলে অবাক লাগে। কবুতর কীভাবে পথ চিনে বার্তা পৌঁছে দেয় । তবু একটু ব্যাখ্যা করলে আমরা সহজেই বুঝতে পারি।
প্রথমত কবুতর পোষমানা পাখিদের মধ্যে অন্যতম। বাজ বা কিছু শিকারী পাখি যদিও পোষ মানে তবে এরা তৃণভোজী নয়। তাই চিঠি নিয়ে উড়ে যাবার সময় এরা কোনো শিকারের পেছনে ছুটতে পারে। শিকারের সাথে ধস্তাধস্তি করতে গিয়ে হারিয়ে যেতে পারে মূল্যবান চিঠি।
কবুতর তৃণভোজী। উড়ে যাবার সময় নির্দিষ্ট গন্তব্যে থাকে তার দৃষ্টি। তাই হয়ত এই কাজে কবুতরকেই নির্বাচন করা হয়েছিল। তাছাড়া কবুতর অনেক দূর থেকেও নিজের বাড়ি চিনে নিতে পারে। ঢাকার কোনো কবুতরকে বাংলাদেশের দূরবর্তী কোনো জেলা থেকে ছেড়ে দিলেও সে ঠিকই পরদিন হাজির হয়ে যায় মালিকের বাড়িতে। এই ঘিঞ্জি ঢাকা শহরেও মাইকের বাড়ি চিনতে তার অসুবিধা হয় না।
এক শহর থেকে আরেক শহরের মাঝে নির্ধারিত পথ ছিল কবুতরের মাধ্যমে বার্তা বহনের জন্য। একটি কবুতর অতিক্রম করতে পারে এমন দূরত্বে বসানো হত বিশেষ চৌকি। সেখানে কবুতর সহজে চিনতে পারে এমন উঁচু কিছু থাকত। এই চৌকিতে থাকত অনেক উন্নত জাতের কবুতর। খাবার দেয়ার পাশাপাশি কোনো রোগ না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা হত।
চিঠি কবুতরের পায়ে বেঁধে উড়িয়ে দেয়া হত কোনো ছাউনি থেকে। সেই ছাউনি থেকে পরবর্তী ছাউনিতে পৌঁছে যেত কবুতরটি। অপর চৌকিতে থাকা লোকজন সেই চিঠি খুলে বেঁধে দিত অন্য কবুতরের পায়ে। সেই কবুতর উড়িয়ে দেয়া হত পরবর্তী চৌকির দিকে। এভাবে খুব দ্রুত নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে যেত চিঠি।
কবুতরের উড়ে যাবার নির্দিষ্ট পথ ছিল। যেমন এ যুগে নির্ধারিত পথ থাকে বিমান চলাচলের। কবুতর যেহেতু উড়ে যায় তাই পাহাড়, নদী, বন অথবা গিরিখাদ এসব কোনো বাধা ছিল না। এক শহর থেকে আরেক শহরের সবচে কম দূরত্বের পথে পৌঁছে যেত বার্তা।
অবশ্য বেশি গোপনীয় বার্তা এভাবে পৌঁছানো হত না। প্রয়োজন হলে আশ্রয় নেয়া হত সাংকেতিক ভাষার। শত্রুর ভয় থাকলে এড়িয়ে যাওয়া হত এই পদ্ধতি। কারণ পথিমধ্যে শত্রু তীর ছুঁড়ে মেরে ফেলতে পারে কবুতর। মোটকথা, অপেক্ষাকৃত দ্রুততম সময়ে বার্তা পৌঁছানোর মাধ্যম ছিল এটি। এজন্য কবুতরের চৌকিতে রাখতে হত দক্ষ প্রশিক্ষক। ব্যবস্থা করা হত উন্নত খাবারের। রোগ যেন না হয় সেজন্যও থাকত ওষুধপত্র।
ঘোড়ার ডাক
চিঠি পৌঁছানোর আরেকটি প্রচলিত মাধ্যম ছিল ডাক। আরবিতে ডাকব্যবস্থাকে বলা হয় বারিদ। উমাইয়াদের শাসনামল থেকে ইসলামি রাষ্ট্রে ডাক বিভাগের প্রচলন শুরু হয়েছিল। বারিদ শব্দটি এসেছে মূলত ফার্সি থেকে। বারিদায়ে দুম মানে লেজ কাটা ঘোড়া। পারস্যের সম্রাটের বার্তাবাহকরা যেসব ঘোড়ায় চড়ত সেসব ঘোড়ার লেজ কেটে দেয়া হত চিহ্নিত করার জন্য। পরে বারিদ শব্দটি ব্যবহার হয় আরবির ক্ষেত্রেও।
সাধারণত ঘোড়ায় চড়ে এক শহর থেকে অন্য শহরে যেতে যতটুক সময় লাগে তার চেয়েও অনেক কম সময়ে পৌঁছে যেত ডাক। এর জন্য ছিল বিশেষ কিছু ব্যবস্থা। প্রথমত বেশ উন্নত জাতের ঘোড়া ব্যবহার করা হত ডাকবহনের কাজে। এক্ষেত্রেও পথে পথে ছিল চৌকি। এসব চৌকিতে ঘোড়া বদল করা হত। এক ঘোড়ার পক্ষে অবিরাম পথ চলা অসম্ভব। পথিমধ্যে বিশ্রামের জন্য যাত্রা বিরতি করলে দেরি হয়ে যাবে চিঠি পৌঁছাতে। তাই ঘোড়া বদল করা হত এই ব্যবস্থায়। কালাকশান্দি তার সুবহুল আশা গ্রন্থে বলেছেন এমন চৌকির কথা। সেসময় মিশরের মামলুক সাম্রাজ্যে ১৮০২ টি ডাক চৌকি ছিল বলে তার গ্রন্থে উল্লেখ পাওয়া যায়।
শুধু ঘোড়াই নয়, কখনো কখনো বদল হত ডাক হরকরাও। সরকারি জরুরি ফরমান হলে দ্রুত পৌঁছাতে এই পদ্ধতি ব্যবহৃত হত। রাজকীয় বিশেষ ফরমান থাকলে ডাক হরকরার সাথে থাকত রক্ষী বাহিনীও।
বাতিঘর
বার্তা পাঠানোর আরেকটি পদ্ধতি ব্যবহার হত প্রাচীন যুগে। রোমানরা এই পদ্ধতি আবিষ্কার করে। মুসলিম খলিফাদের সময়েও এই পদ্ধতির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। একে আমরা বাতিঘর পদ্ধতি বলতে পারি।
বাতিঘরের কথা আমরা সবাই জানি। সমুদ্রের আশেপাশে কিংবা দ্বীপ অঞ্চলে বাতিঘর নির্মাণ করা হয়। রাতের বেলা বাতিঘরের আলো দেখে পথ খুঁজে পায় নাবিকের দল। তবে বার্তা পাঠানোর এই বাতিঘর তৈরি করা হত পাহাড়ি অঞ্চলে। এক বাতিঘর থেকে সাংকেতিক আলো জ্বালানো হত। সেই আলো দেখে আলো জ্বালাত পরের বাতিঘরের লোকজন। এভাবে বার্তা পৌঁছে যেত নির্দিষ্ট গন্তব্যে। ইসলামের প্রথম দিকে মুসলিম সৈন্যরা যখন বাইতুল মাকদিস আক্রমণ করে তখন এক রাতেই সংবাদ পৌঁছে গিয়েছিল কন্সট্যান্টিনোপলে রোমান সম্রাটের কাছে। কারণ জেরুজালেম থেকে কন্সট্যান্টিনোপল পর্যন্ত এমন বাতিঘর তৈরি করে রেখেছিলেন রোমান সম্রাট।
ইরাকের দজলা ও ফোরাত নদীর দু পাশে এমন বাতিঘর তৈরি করেছিলেন মুসলিম খলিফারা। মিসরের সিনাই অঞ্চলেও ছিল বাতিঘর। পাহাড়ি অঞ্চল ছাড়া অবশ্য বাতিঘরের মাধ্যমে বার্তা পাঠানো যায় না। সেখানে কবুতরই একমাত্র উপায়।
বাতিঘরের মাধ্যমে মূলত শত্রুর আক্রমণ এবং জয়-পরাজয়ের বার্তা দেয়া হত। সাধারণ মানুষের চোখে এমনকি শত্রুরাও দেখতে পেত এই আলো। তাই গোপনীয়তা রক্ষা করা সম্ভব ছিল না একটুও।
এ যুগে যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক উন্নত হয়েছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে মিলি সেকেন্ডের মাধ্যমে আমরা বার্তা পৌঁছে দিতে পারি পৃথিবীর অপর প্রান্তে। এতে দ্রুতগতির সাথে সাথে গোপনীয়তাও বেড়েছে। প্রাচীন যুগের এসব গল্প এখন রূপকথা মনে হয়।
তবু মনে একটা প্রশ্ন জাগে। আমাদের প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সাথে সাথে আমরা বিশ্বস্ততার মত মহামূল্যবান গুণ কীভাবে হারিয়ে ফেললাম? প্রাচীনকালে হাতে করে দূর-দূরান্তে চিঠি বহন করা হত। সিলগালা করে বন্ধ করা হত খামের মুখ। চিঠির বাহক বা কেউই সে চিঠি খুলে দেখার কথা চিন্তা করত না। কিন্তু এ যুগে এত গোপনীয়তার পরও ইমেইল হ্যাক করা হয়। ফাঁস করে দেয়া হয় গোপন চিঠি ও ব্যক্তিগত আলাপন। গতিলাভের সাথে সাথে কী আশ্চর্যজনকভাবে আমরা নৈতিকতা হারিয়েছি। তাই না?