রমজানের চাঁদ উঠতেই আমরা একটা হিসেব করে ফেলতাম, কবে ঈদ হবে? দশ রমজান পেরুতেই শুরু হতো কত চিন্তা–এবার ঈদটা কোন দিন পড়বে, ঈদের দিন যদি তুমুল বৃষ্টি হয় তো কী হবে, কাঠফাটা রোদে ঘোরাঘুরির কষ্ট কেমন–ইত্যাদি নিয়ে চলত নানা জল্পনা-কল্পনা। বিগত ঈদের স্মৃতি ও অভিজ্ঞতাও যোগ হতো এর সঙ্গে। পেছনের কথা উঠলে আর কোনো বিরাম নেই। একই রকম ঘটনা প্রায় সকলের ঝুলিতেই আছে। ‘আমারও একবার এমন হয়েছিল’Ñএই বলেই কাটতে শুরু করত গল্পের কাটিম। একজন শেষ করার আগেই আরও দু’তিনজন চটপট গল্প শুরু করে দিত। যে যাকে ধমক দিয়ে বসাতে পারত সেই চালিয়ে যেত তার গল্প।
২০ রমজান পার হতেই শুরু হতো আমাদের তোড়জোড়। রাস্তার ধারে বসত কার্ডের পসরা। ছোট ছোট ছেলে বস্তা বিছিয়ে বসত কার্ড নিয়ে। আর যারা একটু বড়, বাঁশের খুঁটি গেড়ে ওপরে চালা বিছিয়ে দিত। খুঁটির এ মাথা ও মাথা টানটান করে বাঁধা হতো মোটা সুতো। বিভিন্ন রকমের সাদাকালো ও জমকালো কার্ড ঝুলত সুতো ধরে। পথ চলতে চলতে আমরা দাঁড়িয়ে পড়তাম। একই দোকানে। একই সময়ে। প্রতিদিন। বারবার।
২৫ রমজানের দিকে হেফজখানা বন্ধ হয়ে যেত। আমরা তার আগেই কার্ড কিনে দাওয়াত দেওয়ার পর্ব সারতাম। ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সঙ্গে একটা চাপা প্রতিযোগিতা চলত যে, কে কাকে আগে কার্ড দিতে পারে। আবার নিজেরটা হতে হবে বেশি সুন্দর। ফলে দিই দিই করেও আর দেওয়া হতো ন। একেবারে শেষ দিন বাড়িতে যাওয়ার পূর্বে মোলাকাত করতে করতে একে অন্যের হাতে গুঁজে দিতাম দাওয়াতি কার্ড। কিন্তু আমরা খুব ভালো করেই জানতাম, কেউ কারো বাড়ি যেতে পারব না। কত দূরে দূরে চলে যাব একেকজন। এমনকি ঈদের দিনে ঈদ মোবারকটা পর্যন্ত বলতে পারতাম না। মোবাইল ছিল না তেমন। মাদরাসা খুললেই চলত বাসি ঈদ বিনিময়। আর সপ্তাহজুড়ে জারি থাকত ঈদের ‘গপ্প’। নিজ এলাকায় কার্ড দিতাম চাঁদ-রাতে। যখন চাঁদ উঠত, আমরা হৈহৈ করে বের হয়ে যেতাম। সালাম-মুসাফাহা করে ঘুরতে থাকতাম। এথা নয় হেথা নয় অন্য কোথাও! আগামীকালকে কেন্দ্র করেই ঘুরত কথার চরকি। এশার নামাজ পড়তাম একসঙ্গে। আগামী কাল কখন, মসজিদের কোন জায়গায় আসব তা ঠিক করে নিতাম। তারপর পকেট থেকে সযতেœ বের করতাম দাওয়াতি কার্ড। বাড়িয়ে দিতাম বন্ধুর সামনে। কার্ড বিনিময় শেষে ফিরতাম বাসায়।
আমরা কার্ড কিনলেও খাম কিনতাম না। আটা গুলে বানাতাম আঠা। আর রঙিন কাগজ ভাঁজ করে তৈরি করতাম মনের মতো খাম। কোনোটা হতো লম্বা। কোনোটা-বা চওড়া। খামের ওপর আঁকা হতো নানান নকশা৷ এক পাশে থাকত প্রেরক ও প্রাপকের নামধাম। আমরা ভাইবোনেরা মিলে খুব উৎসাহ নিয়ে তা বানাতাম। মাঝেসাঝে কার্ডও বানিয়ে ফেলতাম। শক্ত কাগজ কেটে তৈরি হতো সেই কার্ড। ভেতরের কারুকাজ-লেখাজোঁকা সবই হতো হাতে। চারকোণায় ছোট ছোট রঙিন স্টিকার লাগিয়ে দিতাম। আলো পড়তেই ঝিকমিক করে উঠত ওগুলো। আর বন্ধুদের দেওয়ার সময় হাসি হাসি মুখ করে সগর্বে বলতাম, ‘কার্ডটা কিন্তু আমি বানিয়েছি!’
ঈদের নামাজ পড়েই প্রথমে আমরা একে অন্যের বাসায় যেতাম। তারপর টইটই করে ঘুড়ে বেড়াতে নেমে পড়তাম রাস্তায়। সেলামি যা পেতাম তা শেষ করতাম এটা-সেটা খেয়ে। রাস্তার দু’ধারে বসত নানান রকমের তামাশা। কিছু দূর পর পরই থাকত চটপটি-ফুসকার অস্থায়ী দোকান। আমরা খেতাম আইসক্রিম চকোলেট চিপসÑএ ধরণের খাবার। অবশ্য ধরাবাঁধা কোনো নিয়ম ছিল না। আমাদের প্রধান কাজ ছিল হণ্টন। হেঁটে হেঁটে যখন পায়ে ব্যথা ধরে যেত তখন বাসায় ফিরতাম। যদিও ফিরতে আমাদের ইচ্ছে করত না এক বিন্দুও, তবুও পেটের টানে ফিরতে হতো। ফেরার সময় অমুক মসজিদে আসর পড়ার চুক্তি হতো। মাথা নেড়ে চুক্তিতে সম্মতি জানিয়ে আমরা সমাপ্ত করতাম হণ্টনের প্রথম পর্ব।
দুপুরে খেয়ে-দেয়ে বাসায় থাকতাম। বসে বসে মাথা ধরে যেত। কিন্তু ইচ্ছে হলেই টুং করে একটা ম্যাসেজ করা যেত না। অমুক জায়গায় আয় বলে উড়ন্ত চিঠি পাঠানো যেত না কোনো বন্ধুকে। বরং নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বসে থাকতে হতো ঝিম মেরে। এ ছাড়া কোনো উপায়ও ছিল না। আসরের আজান হলেই প্রায় লাফিয়ে উঠতাম। নামাজ শেষে আরেক চোট হেঁটে আসতাম মন যেদিকে চায়। সন্ধ্যার ছায়া আকাশে যত ঘন হয়ে আসত আমাদের মনটাও তত মলিন হয়ে যেত। ‘ইশ শেষ!’ এই বলে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছড়িয়ে দিতাম বাতাসে।
হঠাৎ, একদমই আচমকা একটা ঝড়ো বাতাসে উল্টে গেল আমাদের ঈদগুলো। সেই হৈহৈ করে কার্ড বানানোর আনন্দ ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেল। সারাদিন রাস্তায় হাঁটাহাঁটিও হয়ে উঠল পানসে। একে অন্যের বাসায় যাওয়া-আসা হয়। কিন্তু সেই ঈদের আনন্দ আর আসে না।
এখনকার ঈদ বন্দী হয়ে পড়েছে মুঠোফোনে। ঈদের আনন্দগুলো খাবলিয়ে নিয়ে গেছে ফেসবুক। ম্যাসেঞ্জারের টুংটাং আওয়াজে ঘণ্টা বেজে গেছে মুক্ত ঈদের৷ কার্ড করার ঝামেলা আর কে করে! মোবাইল থেকে টুক করেই দেওয়া যায় ঈদ মোবারক। এখন তো সেটাও দুর্লভ হয়ে আসছে। ঈদ মোবারক লিখে ফেসবুকের দেয়ালে সাঁটিয়ে দিয়েই খালাস। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় বসেও আড্ডা জমে না। সকলের চোখই নিবদ্ধ মোবাইলের স্ক্রিনে৷ ভাইব্রেশনের ভোঁ ভোঁ আওয়াজে রিরি করতে থাকে কানদু’টো।
এখনকার ঈদগুলোকে আর বিমলানন্দ লাগে না। নামাজ শেষেই একটা বিষণœতা এসে কোলাকুলি করে যায়। বাসায় বসে সেমাইয়ের পিরিচ হাতে নিয়ে ঠায় বসে থাকি কিছুক্ষণ। স্মৃতি হাতড়ে খোলস মুক্ত করি পুরোনো ঈদগুলোকে। সেই চটপটে ঈদগুলোর ডানা ঝাপটানো দেখি। একটা সুন্দর সৌরভ ভেসে আসে নাকে। ঘ্রাণ টানার একটা আওয়াজ করেই চোখ মেলি। আর দেখি সামনে দাঁড়িয়ে আছে একহারা গড়নের একটা ঈদ। কানে ভেসে আসছে ম্যাসেজের টুংটাং শব্দ। আমার কানে বাঁজখাই আওয়াজ তুলছে ওগুলো। ভাবতে থাকি, আহা, কতই না সুন্দর ছিল হারানো ঈদগুলো!
জুন ২০১৮