নীরব রজনী। নিস্তব্ধ রাত। তিমির অন্ধকার। অন্ধকার, নীরবতা আর নিস্তব্ধতার সঙ্গী হয়েই আমার চারপাশ ঘুমের কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। বৃষ্টি-ধোয়া আকাশে একফালি চাঁদ ছিল, এখন মেঘেদের নীরব মিছিলে হারিয়ে গেছে। তার স্নিগ্ধ কিরণ–যা এতক্ষণ কোমল বিকিরণ ছড়াচ্ছিল, আকাশে স্নিগ্ধতার রেখা টেনে যাচ্ছিলÑতাও ফিকে হয়ে গেছে রাশি রাশি মেঘের আড়ালে।
পূর্ণিমার জোছনা কিংবা একফালি চাঁদের স্নিগ্ধতা কত যে প্রেমিক-মনকে প্রেমের স্বচ্ছ সরোবরে অবগাহনের এবং নির্মল ও প্রাণবন্ত আবেগোচ্ছ¡াসের অভিলাষী বানিয়েছে, তার হিসেব রাখার সাধ্যিই-বা রাখে ক’জন?
কিন্তু এত আবেগ আর উচ্ছ¡াসের পরও রজনীর নীরবতা আমার দগ্ধ হৃদয়ের যন্ত্রণা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। আমার জখমি দিল থেকে অনবরত রক্ত ঝরাচ্ছে। রাতের গভীরতা যত বাড়ছে আমার যন্ত্রণাও তত যন্ত্রণাময় হয়ে উঠছে। তাই ভাবছি এই নিস্তব্ধ রাতের নির্জনতায় নিজেকে সান্ত¦না দিতে, হৃদয়ের মাঝে পুঞ্জীভূত যন্ত্রণার বোঝা কিছুটা হলেও হালকা করতে আজ আমি কিছু লিখব। লিখব আমি, তবে কলমের কালিতে নয়, লিখব চোখের লোনা জলে। যার মাঝে কলমের কালির সাথে মিলন ঘটবে কলবের। কলমের কালির সাথে সম্মিলন ঘটবে তপ্ত অশ্রফোঁটার।
হ্যাঁ, এই নিঃসঙ্গ রাতে আমি লিখব। অশ্রæর কালিতে লিখব পুণ্যভূমি শামের কথা। হৃদয় থেকে ঝরা রক্তের কালিতে লিখব সিরিয়ার কথা। আমি লিখব আজ সিরিয়ার নির্যাতিত ভাই-বোনদের কথা। নিপীড়িত ভাগ্যবিড়ম্বিত মুসলমানদের ব্যথা। যারা অর্ধ-দশকের চেয়েও বেশি সময় ধরে সয়ে আসছে ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম শত নির্যাতন। সয়ে যাচ্ছে মানবেতিহাসের হৃদয়বিদারক বীভৎসতম যত নিপীড়ন।
আজ আমি লিখব এই উম্মাহর ‘দিলের ধড়কন’ পুণ্যভূমি শামের কথা। উম্মাহর হৃদয়ের স্পন্দন সিরিয়ার কথা। সিরিয়ার দেশছাড়া, বাস্তুহারা এবং বছরের পর বছর অভিবাসী হয়ে থাকা অসহায় বনি আদমের কথা; যাদের দিন কাটছে অনাহারে, খোলা আকাশের নিচে এবং রৌদ্রতাপে। আর রাত কাটছে তিমির অন্ধকারে, বিক্ষুব্ধ ঝড়ের কবলে মৃতপ্রায় হয়ে এবং শীতের প্রচÐ প্রকোপে।
আহ, প্রিয় নবিজির প্রিয় উম্মাহর কী হৃদয়বিদারক অবস্থা! শ্রেষ্ঠ উম্মাহর কী নির্মম জীবনযাপন!
তারা নিজের চোখের সামনে প্রিয় মাতৃভূমিকে জ্বলতে দেখছে।
অসহায় চোখে প্রিয় দেশকে বিধ্বস্ত হতে দেখছে।
এরচেয়ে রক্তভেজা এবং বেদনাদায়ক দৃশ্য কী হতে পারে?
এরচেয়ে অশ্রæভেজা এবং মর্মবিদারক যন্ত্রণা আর কোথাও আছে?
আজ আমি লিখব মাতৃগর্ভের সেই সিরিয়ান শিশুটির কথা, যাকে ‘পাষাণ’রা মায়ের গর্ভাশয়ে ছুরি দিয়ে আঘাত করে করে হত্যা করেছিল! কী অপরাধ ছিল নিষ্পাপ শিশুটির? যে তখনো পৃথিবীর আলো-বাতাসই পায়নি। কী অপরাধ ছিল ত্রিশূলে গেঁথে নৃশংসভাবে হত্যা করা হালাবের সেই নিষ্পাপ শিশুগুলোরÑযাদের নিষ্পাপ চাহনী এখনো ঘুমোতে দেয় না শত মাকে, সহ¯্র বাবাকে এবং দূরদেশের ‘হাজারো মুসাফির’কে?
কী অপরাধ ছিল হালাবের এবং হালাবের বাসিন্দাদেরÑযাদের নির্মমভাবে শহিদ করা হয়েছিল? নয়নাভিরাম এই শহরকে বিধ্বস্ত করে দেয়া হয়েছিল। মৃত্যুপুরীতে পরিণত করা হয়েছিল।
কী অপরাধ ছিল গুতা’র এবং গুতার মুসলমানদের? যাদের হৃদয়বিদারক শাহাদাত দেহকে নিথর করে দেয়। নিশ্চল করে দেয়। মনকে করে দেয় স্থবির। ‘লাল-কালো’ শয়তানগুলো থোকা থোকা ফলমূল ও সারি সারি বাগানে ঘেরা আর নৈসর্গিক সৌন্দর্যের তিলোত্তমা এই নগরীকে অগ্নীপুরী বানিয়েছে।
হায়, মানবতা ও মানবাধিকার!
হায়, মুসলিমবিশ্ব ও মানবতার দাবিদার!
কেন এখনো মানবতা নীরব-নিশ্চুপ?
কেন এখনো মুসলিমবিশ্ব নির্বিকার?
গতকাল আমরা আমাদের আরাকান হারিয়েছি। মিয়ানমারে নিগৃহীত হয়েছি।
পরশু তারা আমাদের প্রাণভোমরা, হৃদয়ের স্পন্দন বাইতুল মাকদিস কেড়ে নিয়েছে। আমাদের আল-আকসা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। তবুও আমরা জাগিনি। এখনো সুখনিদ্রায় বিভোর হয়ে আছি! তবে আর কবে জাগব?
ইরাকে নিগৃহীত হয়ে, সিরিয়া থেকে বিতাড়িত হয়ে?
নাকি পুরো মানচিত্র থেকে আমাদের নাম-নিশান মুছে গেলে?
মে ২০১৮