স্কুল ঘরের সামনে প্রকাণ্ড এক কৃষ্ণচ‚ড়া গাছ। তার নিচে দুটো আধভাঙা বেঞ্চ। বসে আছি আমি। প্রথম দিন স্কুলে এসেছি। ভর্তিও হইনি। চুমকি নামের মেয়েটা বরই সেধে দিল। বরই খেতে খেতে ভাবছি, ভর্তি হব কী করে। আমি তো কিছুই জানি না। হাঁটতে হাঁটতে টিচার্স রুমের সামনে এলাম। ভর্তি হতে হবে আমাকে। যে করেই হোক।
‘এই ছেলে, এদিকে আমার কাছে এসো।’ ভরাট গলার আওয়াজে আমার ভয় পেয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু আমি ভয় পেলাম না। ছেলেবেলায় একদম ভয় পেতাম না কাউকে। গুটি গুটি পায়ে তাঁর দিকে এগিয়ে গেলাম। কাছে যেতেই পরম স্নেহে তিনি আমার দু’হাত ধরলেন। আদরমাখা গলায় জানতে চাইলেন নাম-পরিচয়, ‘আগে কিছু পড়েছ বাবু?’
‘হ্যাঁ, অনেকগুলো কবিতা আমি মুখস্থ বলতে পারি।’
‘আচ্ছা, তাই নাকি! বলো তো একটা কবিতা।’
আমি মুখস্থের ঝাঁপি খুলে গড়গড় করে একটি কবিতা শুনিয়ে দিলাম। তাঁর মুখটা হাসি হাসি। তিনি আমার কবিতা শুনে আনন্দ পাচ্ছেন। আমি বুঝতে পারছি।
তাঁর চেয়ারটা ছিল অন্যসব চেয়ারের চেয়ে ভিন্ন। একটু বড়। উন্নতও বটে। লাল একটি রুমাল দিয়ে মুড়িয়ে রাখা। কী সুন্দরই না দেখাচ্ছে চেয়ারটা! দেখলেই বসতে ইচ্ছে করে!
টুংটাং আওয়াজে বেল বেজে উঠল। তিনি চেয়ার থেকে নেমে আমাকে বসালেন তাঁর চেয়ারে। ব্যস্ত পায়ে হেঁটে তারপর চলে গেলেন ক্লাসে। যাওয়ার সময় বলে গেলেন, ‘এখানেই বসে থাকবে। যাবে না কিন্তু! তোমার কাছ থেকে আরো আরো কবিতা শুনব।’ আমি মাথা নাড়লাম।
লাল টুকটুকে রুমালটা দু’হাতে ছুঁয়ে দেখছি। কী কোমল! চেয়ারটাতে বসতে পেরে আনন্দ যেন ধরে না আমার।
ক্লাস সেরে স্যার এলেন। আমার মুখস্থ সব কবিতাই খুঁটে খুঁটে শুনলেন। মুগ্ধও হলেন বোধহয়। তাঁর মুখের আনন্দমাখা হাসি দেখে তা-ই মনে হলো। কয়েকটা মুখস্থ সুরাও শুনিয়েছিলাম স্যারকে। তখন যে স্যার কত্ত আনন্দিত হয়েছিলেন সেটা প্রকাশের ভাষা আমার নেই। আবছা চোখে ভাসে, স্যারের চোখের কোণ ভিজে উঠেছিল সেদিন। রুমালে বারবার চোখ মুছছিলেন।
তারপর থেকে স্যার আমাকে ভীষণ ভালোবাসতেন। আমার প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল সবার চেয়ে বেশি। ক্লাসে এসে প্রতিদিন আমাকে কাছে ডাকতেন। আদর করতেন। কবিতা শুনতেন। কুরআন তেলাওয়াত শুনতেন আর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলতেন, ‘তোমার মতো করে যদি কুরআন পড়তে পারতাম!’
আমার এই কপালটাতে স্যারের কত্ত যে চুমু আঁকা আছে, তার হিসেব নেই! স্যারের এইসব আদরের স্মৃতি বুকে নিয়ে বেঁচে থাকাটা বড্ড আনন্দের!
একদিনের কথা। বাসায় রাগ করে আমি টিফিন আনিনি। সবাই যখন টিফিন খাচ্ছে আমি তখন কৃষ্ণচ‚ড়ার তলায় মন খারাপ করে বসে আছি। স্যার ডাকলেন আমাকে। নিজের আনা টিফিন আমাকে খাওয়ালেন। বললেন, টিফিন না আনলে আমার সঙ্গে খাবে। তারপর থেকে মাঝেমাঝেই স্যার বেশি করে টিফিন নিয়ে আসতেন। আমাকে সঙ্গে নিয়ে খেতেন। খাওয়া শেষে বলতেন, ‘এবার আমার খাবারের বিলটা দাও।’
আমি বুঝতাম, স্যার তেলাওয়াত শোনাতে বলছেন। একটা সুরা শুনিয়ে দিতাম। চোখ বন্ধ করে নিবিষ্ট মনে স্যার শুনতেন সেই তেলাওয়াত।
আমিও কখনো কখনো ভালো কিছু রান্না হলে স্যারের জন্য নিয়ে যেতাম। খাওয়া শেষে স্যার বলতেন, ‘আজ তো তোমাকে বিল দিতে হবে। দাও কপালটা এগিয়ে দাও, একটা চুমু দিই।’ স্যারের সেইসব চুমুর ছোঁয়া আজও অনুভব করি।
প্রথম দিনের পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই আমি স্যারের চেয়ারে গিয়ে বসে থাকতাম। ক্লাস শেষে স্যার এসে পাশের চেয়ারে বসতেন। ধমক তো কত দূরে, উঠতেও বলতেন না কোনোদিন। এই উদারতা স্যারকে আমার কাছে অনন্য করেছে। সেজন্যই হয়ত স্যারকে কোনোদিন ভুলতে পারব না। তাঁর স্মৃতি বয়ে বেড়াব সারাটা জীবন।
বোশেখের এক ঝড়ের দিনের কথা। সকাল থেকেই মেঘ মেঘ করছে। স্কুলে অল্প কয়েকজন ছাত্র এসেছে। আমি কোনোদিন স্কুল কামাই দিতাম না। স্কুল পালানোর স্বভাবও আমার ছিল না। ওই মেঘ-বৃষ্টি ডিঙিয়ে সেদিনও স্কুলে এসেছিলাম। হঠাৎ চারদিক অন্ধকার করে ঝড় উঠলা। আকাশের গর্জনে আমরা ভীষণ ভয় পাচ্ছিলাম। টিচার্স রুমে
আমাদের বসতে দেওয়া হলো। আমি স্বভাবমতো স্যারের চেয়ারে গিয়ে বসে পড়লাম। কোনো চেয়ার আর খালি নেই। সবগুলোতে ছাত্ররা বসে আছে। স্যার এসে বসার জায়গা না পেয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। অন্য এক স্যার আমাকে ধমক দিয়ে চেয়ার ছাড়তে বললেন। আমি কাঁদো কাঁদো হয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াচ্ছিলাম। স্যার আমার ঘাড়ে হাত দিয়ে বসিয়ে দিলেন। ওই স্যারকে রাগঝরা চোখে শাসিয়ে বললেন, ‘অবুঝ একটা ছেলেকে এভাবে ধমক দেন কেন? বুঝ হলে ও এমনিতেই আর বসবে না। ওকে আর কখনো ধমক দেবেন না।’ ওই দিনের পর আর কোনোদিন স্যারের চেয়ারে বসিনি।
তৃতীয় শ্রেণীর পর বাবা আমাকে হিফজখানায় ভর্তি করে দিলেন। স্যারের কাছে যেদিন বিদায় চাইতে গিয়েছিলাম, সেদিন স্যারের কান্না দেখে আমারও খুব কান্না পেয়েছিল। রুপালি ফ্রেমের চশমার ফাঁক গলে চোখের জল বেরিয়ে আসছিল তাঁর। ধরা গলায় বারবার বলছিলেন, ‘তুমি যদি হাফেজি পড়ার জন্যে না যেতে তাহলে কখনোই আমি তোমাকে যেতে দিতাম না।’ তারপর আমার চোখের জল মুছে দিয়ে বলেছিলেন, ‘যাও, ভালো করে পড়ো। অনেক বড় হও, এই দুআ করি।’
আজ আমি হাফেজ। তারাবির শেষে যখন স্কুলের সেই হেডস্যারের কথা লিখছি, সেদিনের মতো আজও আমার চোখ বেয়ে ফোটা ফোটা অশ্রæ ঝরে পড়ছে।
জুন ২০১৮