দুঃসময়ে ঘেরা ছিল মানুষের যাপিত জীবন। অশুভ শক্তির ডাল-পালা বিস্তৃত ছিল সমাজের চারপাশে। ব্যক্তি সমাজ রাষ্ট্রÑ সর্বত্রই ছিলো অশুভ শক্তির প্রভাব। তখন একটি সুন্দর বিকেল কিংবা একটা আলো ঝলমল ভোর মানুষকে সাময়িক আনন্দ দিলেও প্রশান্তি দিতে পারতো না। পাহাড়ের ছায়া, ঝর্ণার জলধারা, সাগরের ঊর্মিমালা, পাখির কলরব, সূর্যেও লালিমা, জোছনার মোহময়তা, প্রভাতের সমীরণÑ এসব কিছু মানুষের চিত্তকে আন্দোলিত করতো ঠিক কিন্তু আত্মাকে প্রভাবিত করতে পারতো না। কারণ? কারণ একটাই, মানুষের মাঝে তখন মানবতাবোধ ছিলো না। মনুষ্যত্ব যে কী, এর পরিচয়ও তারা জানতো না। মানুষ হারিয়ে গিয়েছিলো পাশবিকতার অতলান্ত আঁধারে।
বিশেষ করে সর্বগ্রাসী জাহালাতে ছেয়ে গিয়েছিলো গোটা আরব জাহান। মূর্খতায় আচ্ছন্ন সমাজে চলতো তমাশার রাজনীতি। সমাজের গতি স্থবির হয়ে পড়েছিলো দুর্বল আসহায়ের আর্তচিৎকারে। আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিলো মাজলুমের নিরুপায় কান্নায়। হিংসা-বিদ্বেষ, মারামারি, খুন-খারাবি, চুরি-ডাকাতি ইত্যকার বদকাজই ছিলো তাদের নিত্যদিনের ফরিজা। মাদপান-জুয়াতামাশা আর প্রকাশ্য লুটতরাজের ছিলো জয়জয়াকার। জৈবিক খায়েশ মেটাতে হামলে পড়তো যার তার ওপর। এমনকি নিজ বাবার অন্য স্ত্রীদেরও উপায় ছিলো না এহেন গর্হিত কাজ থেকে নিজেকে বাঁচাবার। বেঁচে থাকার। নারী পরিণত হয়ে পড়েছিলো ভোগ্যপণ্যে।
ইবাদত হিসেবে করতো লাত-মানাতের পূজা। চন্দ্র-সূর্যের পূজা। মুর্তি পূজা। অগ্নি পূজা। আর সম্পুর্ণ নগ্ন হয়ে খালি গায়ে করতো বায়তুল্লাহর তাওয়াফ। একই উপায়ে তাওয়াফ করতো নারীরাও। এহেন ঘৃণিত নিন্দিত ও মনুষ্যত্ব বিবর্জিত কীর্তি-কাÐ আর অপসংস্কৃতির ভয়াবহ রূপ নিয়ে পৃথিবী যখন ডুবে গিয়েছিলো মানবতার কলঙ্ককালে, আইয়্যামে জাহিলিয়্যাতের তমশাচ্ছন্ন আঁধাওে, ঠিক তখনই অন্ধকারের বুক চিরে পৃথিবীকে একটি সভ্য সমাজ উপহার দেবার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে, শ্বাশত সত্য চিরন্তন শান্তির পয়গাম নিয়ে, বিশ্বমানবতার সুদিনের সুসংবাদ নিয়ে, নিখিল ভুবনে আত্মপ্রকাশ করেন মানবতার মুক্তির দিশারী, আদর্শ সমাজের রূপকার, তামাম জাহানের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব, পিতা আবদুল্লাহ মাতা আমেনার একমাত্র আদরের দুলাল মহানবি হজরত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম।
তাঁর আগমনে মানবতার ভাগ্যাকাশে উদয় হলো নতুন সূর্য। জুলমাতের আঁধারে উদ্ভাসিত হলো হেদায়েতের আলো। কিন্তু মানুষের মুক্তির জন্য মানুষেরই অনাচারের শিকার হলেন তিনি। রক্ত ঝরলো তাঁর তায়েফের মাঠে। উহুদের মাঠে শহিদ হলো দান্দান মুবারক। আর দিকে মানুষের শান্তি কামনায়, মানবতার মুক্তির চিন্তায়, শেষরাতের সিজদায় তাঁর আহাজারিতে দুলে উঠতো খোদা তায়ালার আরশ।
তিনি যে রহমতের নবি! তাঁর সংস্পর্শে এসে মুমূর্ষ মানবতা পেলো নতুন প্রাণ। পথহারা মানব কাফেলা পেলো হেরার রাজতোরণ। পেলো পথের ঠিকানা। তাঁর সহচার্যে জেগে উঠলো একঝাঁক মানবাত্মা। তারা রূপায়িত হলো সোনার মানুষে।
যারা দরদমাখা হৃদয় দিয়ে বিপথগামী অশান্ত ব্যাকুল মানুষকে দেখিয়েছেন চিরায়ত সত্য, শান্তি, মুক্তি ও কল্যাণের পথ। যারা ধুলির ধরণীকে গড়ে তুলেছিলো মানব-কাননের এক নির্মল শান্ত সুন্দর ও সম্ভাবনার আবাস ভূমি রূপে।
দেখতে দেখতে মাত্র তেইশ বছরে বদলে গেলো পৃথিবীর চিত্র। পৃথিবীর ইতিহাস। ভক্ষকেরা পরিণত হলো রক্ষকে। সমাজ বিধ্বংসীরা পরিণত হলো আর্দশ সমাজ গড়ার রূপকার হিশেবে। ভোগ্যতুল্য নারী জাতি পেলো মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকার। পেলো মায়ের মর্যাদা, স্ত্রীর সোহাগ আর বোনের ভালোবাসা। মানুষ মুক্তি পেলো মনুষ্য প্রভুদের দাসত্ব থেকে। আইয়্যামে জাহিলিয়্যাত বদলে গড়ে উঠলো একটি সোনালি জামানা।
বাঁচবার তাগাদায় বিবেকের করোটিতে আজ সদা প্রশ্ন জাগে, কিভাবে সম্ভব হয়েছিলো এই ঐতিহাসিক ইনকিলাব? কেন হারিয়ে গেলো সেই সোনালি কাফেলা? সমাজ থেকে ইতিহাসের পাতায়? তার দেখা কি মিলবে না আর? ইতিহাসের পাতা থেকে সমাজে!
প্রশ্নগুলোর সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়েই শেষ করবো আজকের লেখা। রহমতে আলম সা. তেইশ বছরের নববি জীবনে যে ঐতিহাসিক ইনকিলাব সাধন করেছিলেন এর পুরোটাই ছিলো তাঁর আদর্শিক জয়! আদর্শের শক্তিতেই জাহালতের জুলমাতে নিমজ্জিত মানুষের হৃদয় জয় করেছিলেন তিনি। তাঁর আদর্শের কাছে পরাজিত হয়ে পড়েছিলো সেকালের সব মানবতাবাদ। ভাববাদী গ্রিক দর্শন। রোমীয় সংস্কৃতি। পারসিক সভ্যতা। সব। তিনি তার আর্দশের মহিমায় হয়ে উঠেছিলেন অজেয়। অপ্রতিরোধ্য।
কেমন ছিলো তার অজেয় আদর্শের রূপ? আদর্শ সমাজ গড়ার স্বাপ্নিক সৈনিকেরা এর উত্তর জেনে রাখা বড় দরকার।
উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা রা.-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলোÑ রাসুল সা.-এর আদর্শ কেমন ছিলো? জবাবে তিনি এককথায় বলে দিলেনÑ পবিত্র কুরআনই ছিলো তাঁর আদর্শ। তাঁর চরিত্র।
হ্যাঁ, কুরআনই ছিলো তাঁর সামগ্রিক জীবনাদর্শ। আর তাই আদর্শ সমাজ গঠনে মহানবী সা.-এর ভুমিকাকে আমরা এই ক’টি ধারায় ভাগ করতে পারি। ১. নির্ভেজাল তাওহিদ। ২. তাজকিয়ায়ে নফস। ৩. পারস্পরিক সৌহার্দ। ৪. ইনসাফ এবং ৫. ক্ষমা।
সমাজ বদলের যে বিপ্লবী তাওহিদের শিক্ষা রাসুল সা. দিয়েছিলেন তা হালের শাব্দিক উচ্চারণ শুধু লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকালাহ না। বরং তা ছিলো ইকরার বিল্লিসান, তাসদিক বিল জেনান, আমল বিল আরকানÑ এই তিনের সমন্বয়। যেখানে আল্লাহর বিধান রাসুলের সুন্নাহর খেলাফ কিছুর কল্পনা করাটাও ছিলো অন্যায়। এই তাওহিদে বিশ্বাস করতে প্রথমেই নিজের মনোজগত/আত্মাকে পবিত্র করা লাগে দুনিয়ার সব চাওয়া পাওয়া থেকে। দুনিয়াবি সব সভ্যতা সংস্কৃতি থেকে। নিজের অন্তকরণের পুরোটা জুড়ে তাওহিদকে জায়গা না দিতে পারলে কেউ মুমিন হতে পারে না। আদর্শ সমাজ কায়েম তো দূর কি বাত!
উদাহরণ হিসেবে হজরত উমর রা.-এর দু’টি ঘটনা উল্লেখ করা যায়। উমর রা. একবার তাওরাতের লিখিত কিছু অংশ নিয়ে দরবারে নববিতে হাজির হলেন। তাঁর ধারণা ছিলো তাওরাতের এ অংশ থেকে শিখবার মতো কিছু আছে। রাসুল সা. ইজাজত দিলে তা পড়তে ও শিখতে চান উমর। রাসুল সা. এতে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে বললেনÑ উমর, আল্লাহর কসম! আজ যদি মুসা আ.ও বেঁচে থাকতেন তবে তিনিও আমার আনুগত্য করতে বাধ্য হতেন।
সে উমরই আরেক বার বলেছিলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার জীবন ছাড়া দুনিয়ার সব কিছু হতে আপনি আমার কাছে সবচে’ বেশি প্রিয়। রাসুল সা. বললেনÑ উমর! যে পর্যন্ত না কোনো মানুষ তার জান, মাল, আওলাদ, ফরজন্দ সবকিছু থেকে আমাকে বেশি ভালোবাসবে সে পর্যন্ত সে (প্রকৃত) মুমিন হতে পারবে না।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া রাহ. তার বিখ্যাত জাদুল মুহাজিরি ইলা রাব্বিহি কিতাবে লিখেনÑ যে ব্যক্তি হৃদয়ের গভীরতায় ইমানের লজ্জত উপভোগ করতে অক্ষম সে মুমিন হতে পারে না। বরং তার ব্যাপারে কুরআনে বলা আছেÑ ওয়ালাকিন কু-লু- আসলামনা। আর ইবনে কাইয়্যিম জাওজি রাহ. বলেনÑ যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার পছন্দ কোনো বিষয়কে নাপছন্দ করে অথবা আল্লাহ তায়ালার নাপছন্দ কোনো বিষয়কে পছন্দ কওে, ভালোবাসে, সে তার তাওহিদের দাবীতে মিথ্যাবাদী।
এই নির্ভেজাল তাওহিদের বাহ্যিক আমলই হলো তাজকিয়ায়ে নফস। যার তাওহিদ যতো হকিকি হবে, নির্ভেজাল হবে, তার আমল ততোটাই খালিস লিওয়াজহিল্লাহ হবে। আদর্শ সমাজ গড়ার এ দু’টি শক্তি নিয়েই তেরো বছর মক্কার নির্যাতিত জীবনের ইতি টেনে রহমতে আলম সা. হিজরত করে মদিনায় গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে তৃতীয় ধারাÑ পারস্পরিক সৌহার্দ বা ভ্রাতৃত্ববোধের প্রকাশ ঘটান। এবং এর সাথে ইনসাফ যোগ করে মদিনায় গড়ে তোলেন আদর্শ সমাজ। জীবনের পরতে পরতে ক্ষমার অপূর্ব স্বাক্ষর রেখে রেখে। সব শেষে মক্কা বিজয় করতঃ হত্যাযোগ্য ঘোর দুশমনের প্রতিও ক্ষমার হাত প্রসারিত করে দিয়ে বিশ্বসভায় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনায়কের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
আর ঠিক এভাবেই তাওহিদ তাজকিয়া সৌহার্দ ইনসাফ আর ক্ষমার ইপর ভর করেই বিশ্বজগতে শাšি Íও আদর্শেও সমাজ চালিয়ে গেছেন তাঁর উত্তর পুরুষ সাহাবা আজমাইনগণও। যতো দিন এ আদর্শ বলবৎ ছিলো ততোদিন পৃথিবীতে আদর্শিক সমাজও ঠিকে ছিলো। যখন থেকে এ আদর্শের ঘাটতি দেখা দিতে লাগলো তখন থেকেই হারিয়ে যাচ্ছে আদর্শ সমাজ। কারণ, আদর্শচ্যূত জাতি নিয়ে আদর্শ সমাজ গড়া যায় না। এ পর্যায়ে স্মরণ রাখা দরকার, ইসলামি জীবনাদর্শ অবজার্ভেশন বা সংরক্ষণশীলতা সমর্থন করে না! ইসলামের বিধি-বিধান এমন নয় যে, বিশেষ শ্রেণির লোকেরা বিশেষ কোনো অংশ পালন করবে। যেমন রাজনীতিকরা ইসলামি জীবনাদর্শের এই অংশ মেনে চলবে। অরাজনীতিকেরা ঐ অংশ অনুসরণ করবে। পীর-ফকিরেরা এই এই কাজ নিয়ে মশগুল থাকবে। আর রাজরাজরাগণ ঐ ঐ অংশ নিয়ে খুশি থাকবে। বরং আদব-আখলাক, মোয়ামালাত-মোয়াশারাত, লেনদেন, চলাফেরা, ওঠাবসা সকল বিধান পালনে সব মুসলমান সমানভাবে আদিষ্ট। ফরজিয়াত বিষয়ে সংরক্ষণশীলতার তো প্রশ্নই ওঠে না। একজন শ্রমজীবি মানুষের জন্য যেমন গিবত করা, মিথ্যা বলা, জিনা করা, মদপান করা, গানবাজনা শোনা, আবশ্যিক পর্দা লঙ্ঘন করা ইত্যাদি হারাম তেমনি এজন জনপ্রতিনিধি, একজন আলেম, একজন ইমাম, একজন শায়খ কিংবা একজন রাষ্ট্রনায়কের জন্যও এগুলো হারাম। সমাজের সব মানুষ যখন ইসলামী হুকুম আহকাম ও নববি আদর্শে আদর্শবান হয়ে উঠবে, তখনই সম্ভব হবে আবার আদর্শ সমাজ গড়ে তোলা! আদর্শ নাগরিক হওয়ার নিরন্তর প্রচেষ্টায় ব্যয় হোক আমাদের সকাল-সন্ধ্যা। এই প্রত্যাশায় ইতি।
নবধ্বনি, জানুয়ারি ২০১৮ সংখ্যায় প্রকাশিত