হেদায়া আখেরাইন থেকে দরসে নেজামি’র বাকি পড়াশোনা আমার হাটহাজারী মাদরাসাতেই সম্পন্ন হয়েছে। সেই সুবাদে আল্লাহ তাআলার বিশেষ অনুগ্রহে শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী রহমতুল্লাহি আলায়হি’র সঙ্গে আত্মিক এক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল আমার। হজরতের ইন্তেকাল পর্যন্ত সে সম্পর্ক অটুট ছিল। সেই সম্পর্কের সুবাদে তাঁর একান্ত স্নেহছায়া পেয়ে এসেছি সময়ে সময়ে। এই সুযোগে তাঁর মধ্যে অন্যদের তুলনায় বিশেষ কিছু গুণ দেখতে পেয়েছি। যেগুলো আমাকে মুগ্ধ করেছে, করেছে তাঁর প্রতি অনেক বেশি আকর্ষিত। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম কয়েকটি এখানে উল্লেখ করছি—
ক. হজরত খুব কম কথা বলতেন। চুপ করে অন্যদের কথা শুনতেন বেশি। কারও কথা পছন্দ না হলে মাথা নিচু করে চুপ থাকতেন। অন্যরা মনে করত তিনি ঘুমিয়ে গেছেন। কিন্তু সবার কথা শেষ হলে তিনি সংক্ষেপে কিছু বলতেন। আর সেটাই গৃহীত হতো সিদ্ধান্ত আকারে।
খ. হজরত নিজে গিবত তো করতেনই না, বরং কারও গিবত সহ্যও করতে পারতেন না। চাই তা বাতিল কারও হোক। তাই তিনি বাতিল ব্যক্তির কথা না বলে বাতিল আদর্শের কথা বলতেন। তবে যেখানে ব্যক্তির নাম না নিলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে, সেখানে নাম বলতেন। হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনের সময় নাস্তিকরা মুসলিমদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে তাদের ভাবমূর্তি নষ্ট করত। মুসলিমরা তখন তার জবাব দিতে শুরু করে। কিন্তু হজরত বলে দিয়েছেন, কাউকে আঘাত করে যেন কথা না বলা হয়। আমাকে একদিন বলেছিলেন, ‘কথা বলবে বাতিল আদর্শ ও মতবাদের বিরুদ্ধে। কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে কথা বলবে না।’
গ. হজরত ক্লাসের সময়ের প্রতি খুব যত্নবান ছিলেন। যত কাজই থাকুক না কেন, ঠিক সময়ে উপস্থিত হতেন ক্লাসে। ছাত্ররা ক্লাসে দেরি করে এলে রেগে যেতেন।
আমরা যখন হাটহাজারীর ছাত্র, সেসময় একদিন হজরত ক্লাসে ঢুকে দেখেন অনেকে নেই, অনেকে মাত্র আসছে। আমি ক্লাসেই ছিলাম। তিনি এই এলোমেলো দৃশ্য দেখে রাগত স্বরে বললেন, ‘আজ পড়াব না।’ ছাত্ররা সবাই এসে ক্ষমা চাইল। হজরত বললেন, ‘এক শর্তে ক্ষমা করতে পারি। আগামীকাল সবাই মাথা মুণ্ডন করে আসবে।’ ক্লাসে ৮০০ ছাত্র। সবাই মনে করল এমনিতেই মাথা মুণ্ডাতে বলেছেন। তাই কেউ মাথা মুণ্ডায়নি। একমাত্র আমি মাথা মুণ্ডিয়েছি। পরদিন ক্লাসে এসে হজরত বললেন, ‘তোমাদেরকে মাথা মুণ্ডাতে বলেছিলাম। একজন ছাড়া আর কেউ মুণ্ডায়নি। আমার সব দুআ এই একজনই নিয়ে যাবে।’ ছাত্ররা হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিলে তিনি বললেন, ‘যা হবার, তা তো হয়েই গেছে। এখন কান্না করলে লাভ হবে না।’
ঘ. আমি হাটহাজারীতে যখন পড়তাম, ফজরের পর ঘুমানোর কল্পনাও করতে পারতাম না। হজরত মাদরাসার এ মাথা থেকে ও মাথা ঘুরে বেড়াতেন। যাকে ঘুমে পেতেন শাস্তি দিতেন। যতক্ষণ ঘুম না সরত চোখ থেকে, দৌড়াতে হতো।
ঙ. কথা দিয়ে তিনি কথা রাখতেন, নিজের যতই কষ্ট হোক।
এর সবচেয়ে রাজসাক্ষী আমি নিজে। ২০১১ সালে আমি মক্তব খোলার জন্য বিল্ডিং ভাড়া নিই। রমজানের পর শুরু হবে। আমি হজরতের কাছে বায়না ধরলাম, আপনাকে ছাড়া আমি মাদরাসা শুরু করব না। আপনাকে দিয়েই শুরু করব। হজরত তারিখ দিলেন ১১ সেপ্টেম্বর, বুধবার। ঘটনাক্রমে যে বুধবারে আমাকে তারিখ দিয়েছিলেন তিনি, একই বুধবারে হাটহাজারী মাদরাসারও সবকের ইফতিহাহ। তাঁর একান্ত সচিব মাওলানা শফিউল আলম বললেন, ‘হযরত আসতে পারবেন না। হাটহাজারীতে সবকের ইফতিতাহ সকাল দশটায়।’ কিন্তু হজরত বললেন, ‘কেফায়াতের মাদরাসায় আমি বুধবারেই যাব৷ তাকে বলে দাও।’
আমি ভেবে নিয়েছিলেন, হাটহাজারীর সবক ফেলে তিনি আসবেন না হয়তো। আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি এলেন। হাটহাজারীর ১০টার সবক পড়িয়ে দিলেন ফজরের পর। তারপর ছুটে এলেন আমার মাদরাসায়। মক্তবে সবকের ইফতিতাহ করে জুহরের পর বয়ান করলেন ব্যবসায়ীদের। সেদিন বয়ানে উপস্থিত ছিলেন ২৫০ জন ব্যবসায়ী। হজরত খুশি হয়ে বললেন, ‘এত ব্যবসায়ীর মজলিসে আগে কখনো কথা বলিনি।’
হজরত সেদিন রোজা ছিলেন। বিকেলে ইফতারের আগেই ফিরতি ফ্লাইটে চড়েন। আমরা তাঁর সঙ্গে ইফাতর দিয়ে দিই। তিনি তখন বলছিলেন, ‘আরও কিছু সময় থেকে যেতে পারলে ভালো লাগত।’
হজরতের অল্প কিছু গুণের কথা বলা হলো এখানে, সেই সঙ্গে আমার সাথে তাঁর সম্পর্কের কিছু গল্প বললাম বললাম। পাঠকের মনে হতে পারে হজরত কেবল আমাকেই ভালোবাসেন। বিষয়টা এমন নয়; বরং তাঁর কাছে যে-ই গেছে, সে-ই বলেছে, হজরত তাঁকেই সবচেয়ে বেশি ভালেবাসেন। আসলে বড়রা ভালোবাসার মতো করে ভালোবাসতে জানেন। তাই তাদের ভালোবাসা শতপাত্রে উপচে পড়ে। বড়দের ভালোবাসা আমাদের ছোটদের পথচলার শক্তিশালী পাথেয়। হজরতের ছায়া আমাদের ওপর সরে গেল! আল্লাহ আমাদের হজরতের মর্যাদা পরকালীন জীবনে আরও বাড়িয়ে দিন। আমিন।
পরিচালক, আল-মানহাল মডেল মাদরাসা, উত্তরা, ঢাকা
অক্টোবর ২০২০