কাগজের দেহ যদিও দুর্বল, কিন্তু আমানতদারিতায় যথেষ্ট পোক্ত। বিশ্বস্ত লোকজনকেও যখন আস্থাহীন বোধ হয়, মনের ব্যথা প্রকাশের সকল পাত্র যখন অনুপোযুক্ত হয়ে পড়ে, দেহের দুর্বলতাসত্তে¡ও শক্ত বিশ্বস্ততা নিয়ে কাগজই দেয় তখন বন্ধুত্বের আসল পরিচয়। কিন্তু বন্ধুর সঙ্গে কথা বলার ভাষাটাও তো হওয়া চাই হৃদয়াকর্ষক। তাই ভাবলাম, কলমের ভাষাটা তাহলে করেই নিই খানিকটা মেরামত। শেখার এ আগ্রহ থেকেই আমার এক বন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। বললেন মেয়েকে নিয়ে আমার অনুভূতি লিখে দেখাতে। কী লিখবো! আমি তো কোনো লেখক নই যে, চাইলেই নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করবো! তবু চেষ্টা অব্যাহত রাখলাম। শেষমেষ কলম সায় দিলো। মেয়েকে ঘিরে আমার ভবিষ্যত-পরিকল্পনা ও সঠিক চিন্তা নিয়ে লিখবো, ঠিক করলাম।
লিখতে গিয়ে কাগজ-কলম নিয়ে বসে আছি দীর্ঘ সময়। কিন্তু কোত্থেকে শুরু করব, বুঝতেই পারছি না। ভাবতে ভাবতে মাথায় এলÑআচ্ছা, কতজন কত কী-ই না ভাবে বিয়ের আগে, আমিও তো ভেবেছিলাম সন্তান জন্মের আগে এমন অনেক কিছু। সেখান থেকেই না হয় শুরু করি।
২০১৮-এর ১৮ মার্চ, জমাদিউল আখরের ১৮ তারিখ। দিনটি ছিল শনিবার। খুব ভোরের কথা। আগের দিন রাত বারোটার দিকে মুহতারামাকে নিয়ে ক্লিনিকে গেলাম। স্বাভাবিক ডেলিভারির জন্য ডাক্তার-নার্সদের প্রেসার দিলাম খুব। বাড়তি টেনশনে কপালে আমার শিশির বিন্দুর মতো ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জমছিলো অনবরত। পায়চারি করছিলাম হাসপাতালের করিডোরে। বিড়বিড় করে বিপদের দোআ আওড়াচ্ছিলাম। অবশেষে ঘড়ির কাঁটা যখন আটটার ঘরে, ভেতর থেকে খবর এলÑ‘বাচ্চা নরমালেই হবে, ইনশাআল্লাহ। দুশ্চিন্তার কিছু নেই।’
আমি একরকম স্বস্তির হাঁফ ছাড়লাম। গভীর মনোযোগী হলাম প্রার্থনায়। সৃষ্টিকর্তার স্মরণে পড়লাম তাঁর কালাম। সন্তান অথবা স্ত্রীর কোনো বিপদ হলে কী করবো আমি? কী করা উচিত আমার? দুঃখিত নাকি অন্য কিছু? সন্তান বেঁচে থাকলে, আনন্দে ঘর উজ্জ্বল হলে, তার সঙ্গে কেমন হবে আমার সম্পর্ক? তার প্রতি কী হবে আমার কর্তব্য? ডুবে গেলাম এমন নানা অদ্ভুত ভাবনায়।
কিছুক্ষণ বাদে সংবাদ এলÑ‘আপনার মেয়ে হয়েছে। মা-মেয়ে দু’জনই সুস্থ।’ ‘আলহামদুলিল্লাহ’ পড়ে কৃতজ্ঞতার ঢেঁকুর তুললাম। নবাগতের আগমনে উল্লসিত সবাই। ছেয়ে গেল সর্বত্র আনন্দ। নার্সরাও দাবি করলেন উপরি বখশিশ। সৃষ্টিকর্তার করুণায় পূর্ণ হলো আমাদের জীবন। খুশি হয়েছি বৈ কি! তবে আত্মহারা হইনি। শুধু ভাবছিলাম তাঁর সম্মানে আমার কর্তব্যের কথা। তাঁর কাছ থেকে প্রাপ্তির আশা বা লোভ নয়, বরং দানের আনন্দের কথা। কারণ সন্তান তো ¯্রষ্টার পূর্ণ দানের অমূল্য এক অধ্যায়। নিঃসন্তান পিতার আশার প্রদীপ। লা-ওয়ারিসের রক্ষক। প্রেমের উচ্ছ¡াস থেকেই যার সৃষ্টি। নিষ্পাপ বান্দারূপে যার জন্ম। সৃষ্টির সেরা মানব প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের অনুসারী হয়ে যার শুভাগমন। সর্বকালের সর্বাধুনিক শ্রেষ্ঠ ইসলামই যার স্বভাবধর্ম। পিতামাতার কাছে সৃষ্টিকর্তার সে এক আমানত ও অতুলনীয় অতিথি। কন্যা হলে বয়ে আনে সে পালনকর্তার করুণা। তাঁর নির্দেশেই ছেলে হয় বাবার সাহায্যকারী।
বাইরে বসে বসে ভাবছিলাম এতোক্ষণ। ভেতরে যাবার অনুমতি নেই। ডাক্তার চলে গেলে সুযোগ বুঝে যাওয়া যেতে পারে। আরও কতক্ষণ এদিক-ওদিক করলাম। হঠাৎ জানতে পারলাম ডাক্তারবাবু কেবিন ত্যাগ করেছেন। অমনিই তড়িঘড়ি ঢুকে পড়লাম। মুহতারামা আমার শুয়ে আছেন বিছানায়। অসুস্থতা বেশ জাপটে ধরেছে তাঁকে। পাশেই বসে আছেন মা। মুহতারামার কপালে হাত বুলিয়ে সান্ত¦না দিলাম খানিকটা।
বেশিক্ষণ থাকা গেল না তাঁর পাশে। ডাক্তারবাবু এসে পড়তে পারেন। দেখে ফেললে এক নিঃশ্বাসে ভূরি ভূরি শোনিয়ে দেবেন। চটজলদি তাই বেরিয়ে পড়াই ভালো। এতসব মাথায় নিতে নিতে এলাম পাশের কেবিনে। সেখানে শ্বশুরের কোলে আমার মেয়ে। টুকটুকিকে কোলে নিলাম। এই প্রথম বাবা হওয়ার অনুভূতি। কী চমৎকার! কী ফুটফুটে! আহ, কী অপরূপা আমার মেয়েটি! প্রশংসায় পঞ্চমুখ একেবারে আমি। আনন্দে মন ভরে গেল। দেহমনে দোলা দিয়ে গেল এক স্বর্গীয় ভালোবাসা, নিজের অজান্তেই। ওর প্রতি দায়িত্ববোধ আমাকে ফের চিন্তায় ফেলল সহসাই।
ভাবতে লাগলাম গভীর মনে। আমি কি পারব আদর্শ বাবা হতে! সাহায্য করবে কি আমাকে স্বার্থমুক্ত বাবা হতে আমার চিন্তাধারা! কারণ বাবা-মেয়ের আত্মিক এ পবিত্র সম্পর্ক স্বার্থপরতার বেড়াজালে ধ্বংস করে দিচ্ছে পাশ্চাত্য সভ্যতার ধর্মহীন জীবনযাপন। আর আধুনিকতার নামে অবুঝ মুসলিমরাও গা ভাসাচ্ছে এ ধ্বংসলীলায়। ধার্মিক-অধার্মিক সকলেই আক্রান্ত হচ্ছে এ মহামারিতে। অশান্তি ছড়িয়ে নরকে পরিণত হচ্ছে আমাদের সুন্দর জীবন।
তবে দয়াময় ¯্রষ্টার অসীম কৃপা থেকে নিরাশ হতে নেই ভেবে আশাবাদীও হলাম। সঙ্গে সংকল্প করলাম, সন্তানের আদর্শ গঠনে যেহেতু প্রথম দায়িত্বপ্রাপ্ত হন মাতাপিতা, সন্তানের প্রতি এ দায়িত্বের পূর্ণতা থেকেই যেহেতু শেখে সন্তান তার সর্বপ্রকার দায়িত্ব-কর্তব্য, ভালো-মন্দও শেখে সে অন্যকে দেখে, সবচেয়ে বেশি শেখে মাতাপিতা থেকে, তাঁদের পারস্পরিক সম্পর্ক, ব্যবহার ও মানসিকতা থেকে, তাই নিজের আত্মপ্রচেষ্টা ও প্রার্থনায় সর্বশক্তি নিয়োগ করলে ওর জন্য ভালো কিছু হওয়া অসম্ভবও নয় বটে। নিজের আত্মশুদ্ধিসহ ওর অধিকার প্রতিষ্ঠায় ত্রæটি না করলে এ স্বপ্ন হতে পারে উজ্জ্বল। কারণ সন্তানের মন হলো চুম্বকাকর্ষণ। মা-বাবার ভালো-মন্দ অপ্রকাশ থাকলেও অদৃশ্য শক্তিতে হুবহু ধরা দেয় তার মনে। আজ এতটা দিন বাদে বাস্তব দেখছি এসব আমার মেয়ের মধ্যে। ওর বয়স এখন বছর দেড়েক। আমার মানসিক ও আমলের কোনো পরিবর্তন হলেই ওর মধ্যেও বদল দেখি। কান্নাকাটি থেকে আরম্ভ করে যত অশান্তি শুরু হয় তখন।
জন্মের পর বড় আদর করে নাম রাখলাম ‘আমাতুল্লাহ মুহসানা’। ওকে কোলে করে মনের আনন্দে স্বপ্ন দেখছিলাম সেই তখন থেকেই। প্রথমবার যখন কেঁদে ওঠে খিদেয়, নিয়ে যাই মুহতারামার কাছে। দুনিয়ায় সেটাই ছিল ওর প্রথম খাবার গ্রহণ। ক্লিনিকে থাকাকালে মুহতারামা বললেনÑ‘বাবুর জন্য একটা টিস্যু, প্রেসক্রিপশনের কিছু ওষুধ ও গরম চা আনা দরকার।’ তখনকার সময় আমার পকেটের পরিস্থিতি ছিল বেশ নড়বড়ে। শ-পাঁচেক টাকা হয়তো ছিল সর্বসাকুল্যে। একজনের কাছ থেকে কিছু ধার করে গেলাম জিনিসগুলো আনতে। ক্লিনিক থেকে বেরিয়ে ধারে-কাছে তেমন দোকানপাটের দেখা নেই। মিনিট পাঁচেক পায়ে হেঁটে এগোলেই হয়তো মিলতে পারে কোনো হদিস। চলতে চলতে ময়লাপোতা গিয়ে খুঁজলাম ওষুধের দোকান। চুচু কম্পানির টিস্যু নিলাম একটি। কিন্তু ওষুধটা মিলল না ঠিকমতো। কয়েক দোকান ঘোরাঘুরি করে পেলাম অবশেষে।
ক্লিনিকে ফেরার পথে আবার হারিয়ে গেলাম ভাবনার রাজ্যে। ‘আমাতুল্লাহ’র আগামীর জন্য এখন থেকেই পরিকল্পনা করে কাজ করতে হবে। কিন্তু কী পরিকল্পনা করব! লক্ষ্য স্থির করতে গিয়ে পড়লাম বিপাকে। মাথায় ঘুরপাক খেল হাজারও চিন্তা। অনেক ভাবনার পর মনে এল একটি স্বাভাবিক প্রশ্ন, সত্যিকারার্থে কারোর বাবা-মা কেমন দেখতে চান নিজ সন্তানকে? পার্থিব জগতে থাকুক সে যতই ভালো, হোক সে যেকোনো শিক্ষায় শিক্ষিত, অবশ্যই প্রত্যেকে দেখতে চান সন্তানকে সন্তোষভাজন ও আদর্শবান; চান না সন্তান অবাধ্য কিংবা বখাটে হোক।
এর একমাত্র সফল উপায় সন্তানের মন অবুঝ ও নিষ্পাপ থাকতেই তাকে আদর্শরূপে গড়ে তোলা। মাঝে মাঝে একগাদা উপদেশ, নির্দেশ ও প্রয়োজন পূরণেই শুধু আদর্শিক পূর্ণতা অর্জন হয় না তার। তাকে শুদ্ধ করার নিয়তে বেশি বেশি ভুল ধরলে বিগড়ে যাবার সম্ভাবনা প্রবল। এসবেই কেবল মা-বাবার দায়বদ্ধতা ও আংশিক কর্তব্য পূর্ণ হয়। পূর্ণতা লাভ করবে তো সে মা-বাবার পরিশুদ্ধ মন থেকে। আদর্শের স্বরূপ পিতামাতার থেকেই তৈরি হতে পারে এক আদর্শ সন্তান। সৃষ্টির সেরা মহাপুরুষ প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের প্রতিপালনেই তৈরি হয়েছেন স্বর্গের শ্রেষ্ঠ নারী হজরত ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহা। জান্নাতের শ্রেষ্ঠ নারীর প্রতিপালনেই তৈরি হয়েছেন স্বর্গের শ্রেষ্ঠ যুবকদ্বয় হজরত হাসান ও হজরত হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুমা। ঘর-সংসার পরিচালনা ও সন্তান গঠনে এঁরা হলেন আমাদের উত্তম দৃষ্টান্ত ও আদর্শ।
ভাবতে ভাবতে হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেলাম। মনে পড়ে গেলÑআহা, চা তো নেওয়া হয়নি! ক্লিনিক-লাগোয়া এক দোকানে পেয়ে গেলাম ধূমায়িত চা। চা হাতে আবার পথ ধরলাম ক্লিনিকের। দু’-চোখে ফের ভেসে উঠল আমার স্বপ্নসুখের ফুটফুটে কন্যার সুন্দর অবয়বখানি। তাকে ঘিরে রাজ্যির কল্পনা করতে করতে কখন যে আবার মিলে গেলাম এক ভিন্ন জগতে, গতান্তর নেই নিজেরও।
লেখক : শিক্ষক, আল-জামিআতুল ইসলামিয়া ইসলামপুর (ভবানিপুর মাদরাসা), গোপালগঞ্জ
আগস্ট ২০১৮