১৯৫৮ সালের ১৩ অক্টোবর মদীনায় জন্ম খাসোগির। তুর্কি বংশোদ্ভূত এক সম্ব্রান্ত পরিবারে জন্ম তার। আগে থেকেই সৌদি রাজ পরিবারের সাথে স¤পর্ক ছিল এই পরিবারের।
১৯৮৩ সালে আমেরিকার ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতা বিষয়ে উ”চশিক্ষা গ্রহণ করেন খাসোগি। এরপর সৌদি আরবের বিভিন্ন পত্রিকায় কাজ করেন। ১৯৮৭ সাল থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত সৌদি গ্যাজেট, শারকুল আওসাতসহ বেশ কয়েকটি দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় কাজ করেছেন জামাল খাসোগি। সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধের সময় আফগানিস্তানে গিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করার সময় সবার কাছে পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন তিনি। আল কায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেনের সাথে আফগানিস্তান ও সুদানে একাধিকবার তার সাক্ষাতও হয়েছে। এছাড়া তিনি দ্বিতীয় উপসাগরীয় যুদ্ধের সময়ও কূটনৈতিক ভূমিকা পালন করেন।
১৯৯৯ সালে আরব নিউজের সহকারী সম্পাদক নিযুক্ত হন। এরপর ২০০৩ সালে সৌদি আরবের সবচে জনপ্রিয় ও বহুল প্রচলিত পত্রিকা আল ওয়াতানের সম্পাদক নিযুক্ত হন। তবে এই পদে তাকে বেশিদিন রাখা হয়নি। মাত্র দু মাসের মধ্যে তাকে অপসারণ করা হয়।
তবে এই পদচ্যুতি তার জন্য এমন কিছু সৌভাগ্য বয়ে আনে যা দেখে তার অন্য সহকর্মীরা ঈর্ষান্বিত হয়। আল ওয়াতান থেকে অপসারিত হওয়ার পর আমির তুর্কি আল ফয়সাল খাসোগিকে তার সংবাদ বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেন। তুর্কি লন্ডন ও ওয়াশিংটনে সৌদি রাষ্ট্রদূত থাকাকালে খাসোগি এই দায়িত্ব পালন করেন।
এই সময় বিশ্বের শীর্ষ নেতাদের কাছে খাসোগি সৌদি আরবের রাজনৈতিক ভূমিকা তুলে ধরার সুযোগ পান। সাথে সাথে সৌদি রাজপরিবার ও রাওনীতির সাথেও তার ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। তুর্কি আল ফয়সাল আগে সৌদি গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান ছিলেন। তার সাথে থেকে খাসোগি অনেক তথ্য জানার সুযোগ পান। তাছাড়া বিশ্বে সৌদি আরবের রাজনৈতিক অবস্থান সৃষ্টিতে তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
২০০৭ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালনের পর আরও বড় পরিসরে সাংবাদিকতার পেশায় ফিরে আসেন খাসোগি। আবারও ওয়াতান পত্রিকার সম্পাদক নিযুক্ত হন। ২০০৮ সালে বাদশা আব্দুললাহর সাথে লন্ডন সফরের সুযোগ পান। সেসময় ব্রিটেনের রানীর কাছে আব্দুললাহ খাসোগিকে গুর“ত্বপূর্ণ সৌদি সাংবাদিক বলে অভিহিত করেন। ওয়াতান পত্রিকায় মুক্তচিন্তার পক্ষে লেখালেখির কারণে তাকে তোপের মুখে পড়তে হয়। ২০১০ সালে ওয়াতান পত্রিকা থেকে তাকে আবারও অপসারণ করা হয়।
আল হায়াত পত্রিকায় খাসোগি মুহাম্মদ বিন সালমানের ভিশন ২০৩০ নিয়ে লেখালেখি করতে শুরু করেন। সেসময় সৌদি আরবের পক্ষে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে তাকে বিতর্কে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়। ইয়েমেন যুদ্ধসহ সৌদি আরবের বিভিন্ন কর্মকান্ডকে তিনি তার পেশাগত দক্ষতার
মাধ্যমে সবার কাছে ইতিবাচকভাবে তুলে ধরেন। পত্রিকায় লেখালেখির মাধ্যমে খাসোগি নানা বিষয়ে তার মতামত ব্যক্ত করতে শুর“ করেন। কিছু লেখায় তিনি ইখওয়ানুল মুসলিমিনের পক্ষে সমর্থন পাওয়া যায়। অবশ্য ইখওয়ানের রাজনৈতিক মতাদর্শের বিরোধিতা করতেন।
২০১৭ সালের জুলাই মাসে ট্রা¤প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে খাসোগি সৌদি আরবের সাথে ট্রা¤েপর স¤পর্কের সমালোচনা করে লিখতে শুর“ করেন। সেসময় সৌদি সরকার
একথা ঘোষণা দিতে বাধ্য হয় যে খাসোগির সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। এভাবে সরকারের রোষানলে পড়তে শুর“ করেন খাসোগি। নয়মাস পর্যন্ত তার লেখা প্রকাশ নিষিদ্ধ করে রাখা হয়। নয়মাস পর আবার তিনি ইখওয়ানের পক্ষে লিখেন। এই লেখা প্রকাশ হওয়ার পর হায়াত পত্রিকার সম্পাদক খাসোগির লেখা ছাপানো বন্ধ কর দিতে বাধ্য হন।
এরপর খাসোগি কিছুদিন চুপ থাকেন। এরমধ্যে সৌদি সরকার আলেম, মানবাধিকার কর্মী ও সাংবাদিকদের গ্রেফতার শুর“ করলে তিনি আমেরিকা চলে যান। সৌদি ত্যাগ করার বিষয়ে খাসোগি বলেছিলেন, আমি আমার বাড়িঘর ও আমার পরিবারকে ছেড়ে এসেছি। এখন আমি উঁচু গলায় কথা বলতে পারব। চুপ থকা মানে অপমান ছাড়া আর কিছু নয়।
আমি এখন এমন জায়গায় এসেছি যেখান থেকে আমি কথা বলতে পারব। অনেকের পক্ষে তো তাও সম্ভব না।
খাসোগি তখন থেকে আমেরিকার পত্রিকায় লিখতে শুর“ করেন। ২০১৭ সালের মার্চ মাসে গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত রবার্ট লাইসির সাথে যৌথভাবে লেখা একটি প্রবন্ধে খাসোগি মুহাম্মদ বিন সালমানের সংস্কারমূলক কাজের প্রশংসা করার সাথে সাথে একথা বলেন যে, যুবরাজের এতটুকু সাহস নেই যে তিনি তার সংস্কারমূলক কাজের পদ্ধতি নিয়ে সৌদি আরবে কারও সাথে
আলোচনা করবেন। একই বছর নভেম্বর মাসে একটি লেখায় যুবরাজকে তিনি পুতিনের সাথে তুলনা করেন। লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ আল হারিরিকে রিয়াদে অবর“দ্ধ করে রাখার বিষয়েও সমালোচনা
করেন।
এভাবে খাসোগি সৌদি সরকারের চক্ষুশূল এবং বহির্বিশ্বে জনপ্রিয় ব্যাক্তিত্বে পরিণত হন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার অনুসারীর সংখ্যা প্রায় ১.৭ মিলিয়ন। ইয়েমেন যুদ্ধে সৌদি আরবকে জোর সমর্থন দিয়েছিলেন খাসোগি। সৌদি আরবের ভিশন ২০৩০ ও তুলে ধরেছেন পশ্চিমা বিশ্বের কাছে। একজন সমালোচক হলেও ভারসাম্যতা ছিল তার অনন্য গুণ। সৌদি আরবের পক্ষে এমন অবস্থানও তাকে নিরাপত্তা দিতে পারেনি। যুবরাজের সমালোচনা করায় তাকে হুমকি দেয়া হয়। আগ থেকেই বারবার তাকে দেশে ফেরার জন্য তাগিদ দেয়া হতে থাকে। খাসোগি জানান, আমাকে
আটক করা হবে না এমন নিশ্চয়তা পেলেই আমি ফিরতে পারি।গত ২ অক্টোবর খাসোগি কিছু দরকারি কাগজপর সংগ্রহের জন্য তুরস্কে অবস্থিত সৌদি দূতাবাসের ভেতরে যান। এরপর সেখান থেকে তাকে বের হতে দেয়া হয়নি। এখন পর্যন্ত খোঁজ মেলেনি তার মরদেহেরও।
© 2021 নবধ্বনি - Developed by Shabaka IT