ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। এ-দেশে ঋতুর আগমন ও তিরোধান নিয়মতান্ত্রিক। ছয়ঋতুর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও রূপশৈলীর সিংহভাগ গাঁথুনি গ্রামবাংলায়। যেখানে দিগন্তে চোখ মেললে চোখের পাতা বন্ধ করতে মন চায় না। প্রতিটি ঋতুর রয়েছে স্বতন্ত্র সাজ। শীতকালের রূপসজ্জা শীতবস্ত্রকে ঘিরে। জ্যাকেট, মাফলার, মোজা, চাদর ও উষ্ণ কাপড়ের মাঝে নিহিত শীতের পরিচিতি। পৌষ-মাঘকে ‘শীতকাল’ বললেও মূলত হেমন্তকালেই উত্তরা-বাতাসে বয়ে আসে শীতের আগমনী-বার্তা। কাক-ডাকা ভোরে হাড়কাঁপানো শীত, উঠানভর্তি নীরবতা, কুয়াশার আগ্রাসনে পরাজিত সূর্যোদয়, ইলশেগুঁড়ি কুয়াশার ফোঁটায় সিঁড়িতে বসা দাগ, ঘাসের ডগায় শিশিরবিন্দু, পাখির চেঁচামেচি, কনকনে কুয়াশার ধোঁয়ায় দিগন্তের সংকীর্ণতা—যেন সামনে ধোঁয়ার পাহাড়, কাঁথা-কম্বলের জড়ানো প্রেমে চৌকিবন্দী মানবঢল। খানিক বাদে রবির জাগরণী-শক্তির কাছে নতজানু হয় শীত-কুয়াশার স্বল্পমেয়াদী মৈত্রী। মিঠা রোদ পোহানোর আসর বসে উঠানে। কত গল্প-আড্ডা, কিচ্ছা-কাহিনি, রস্য-রসিকতায় কাটে গ্রামবাংলার শীত-সকাল।
জীবনানন্দ দাশের কলমবাণী হেমন্তকাল হলো ‘ঋতুকন্যা’। হবে না কেন! কত কিসিমের চিত্রবৈচিত্র্যকে পরিচয় করিয়ে দেয় প্রকৃতির সাথে। কাজের মহড়ায় ব্যস্ত থাকে গ্রামীণ আঙিনা, শিশু-কিশোর-জোয়ান-বৃদ্ধাবনিতা-রুপালি-শেফালিদের হাতে কত কাজ। মাঠের দৃষ্টিনন্দিত সরু আইল, সোনারঙা পাকা ধানের গন্ধ, কৃষকের কাঁধে ধান-ভার, বাবার জন্য টিফিন হাতে পল্লীবালকের ক্ষেতগমন—ফার্মের মুরগির মতো শহুরে শিশুরা যে-বয়সে মগ্ন মটুপাতলুর মহীতে, উঠানভর্তি ধানের স্তুপ, মাড়াই মেশিনের ‘ঘ্যাট ঘ্যাট’ গর্জন, ধান ভানতে মহীয়সীদের হাতে কুলা, তার মাঝে অসহ্য রোদ, আমনের নাড়ায় কিশোরের ক্রিকেট আর কিশোরীদের গোল্লাছুট, বিলের ধারে বোরোধানের অগ্রীম প্রস্তুতি, স্রোতস্বিনী শুকিয়ে তলায়, উজান থেকে আসা পলিমাটিতে মৌসুমী চাষীদের দিগ্বিজয়ী উল্লাস, বাজারভর্তি নব্য তরিতরকারি, ফুলকপি, বাঁধাকপি, মূলা, ধনেপাতার ঘ্রাণে জমজমাট শীতকালীন হাটবাজার, জ্বলের বিশ্বাসঘাতকতায় ডুবায় আটকা পড়া কচুরিপানাদের আর্তনাদ, পাতাঝরা বৃক্ষের নীরব প্রতিবাদ, সুজলা-সুফলা শষ্য-শ্যমলা পল্লীর অপরূপ সৌন্দর্য-ঐশ্বর্য এ-বসুন্ধরায় গ্রামবাংলা ছাড়া আর কোথাও নেই। গ্রামীণ রকমারি, নয়নাভিরাম বৈচিত্র্য হৃদয়পুরে গজিয়ে তুলে প্রকৃতিপ্রেমের অঙ্কুর-বীজ। পল্লীভ্রমণের সাথে বেড়ে ওঠে তার ডালপালা। মাঠ-হাওরের অন্তরে প্রান্তরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সাহিত্য-সংস্কৃতির কত বিপ্লবী-বিস্ময়ী উপকরণ। কবি-সাহিত্যিকদের কলম এ-জন্য বোধহয় গ্রামবাংলা ছাড়া চলতে নারাজ। খাটো দিবসে তড়িৎ প্রবাহে আগমন বিকালের। চালের ছিদ্রে গৃহে ঢোকা ক্ষুদ্র কিরণরশ্মির ভেতরে ধুলিকণার ওড়াউড়ি মনোমুগ্ধকর। বিলের স্বচ্ছজ্বলে শাপলা-পদ্মার হাসি, শিউলি-গোলাপ-হাসনাহেনার পুষ্পময়ী সুবাস, লতাপাতায় জ্বলীয় পোকামাকড়ের বিচরণ, তার মাঝে বুনোহাঁসের লুকোচুরি, তীরে অতিথি পাখিদের মিলনমেলা। কী অনবদ্য অবর্ণনীয় সন্ধাবিলের রূপ! সাথে নীরবতায় মৃত্যু হাওরে দিগন্ত বাতাসে মাখা লোকগীতিও বাজে কানে—
‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম আমরা
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম!
গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান
মিলিয়া বাউলা গান আর ঘাটুগান গাইতাম!
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম…’
এভাবে বিলের পারে ব্যর্থ-প্রেমিকের মতো দাঁড়ানো হিজলতলায় আদুলগায়ে রাখালেরা তাদের শৈশবস্মৃতি শোনায় বাকহারা বিলকে। সূর্যের তেজহীনতায় নেমে আসে সন্ধ্যা। এ আরেক নান্দনিকতা! পাতায় পাতায় শিশিরের নির্যাতন, অন্ধকারের চাদরে ঢেকে যায় ধরণী, খালপারে রূপসী-কিশোরীদের ‘তইতই-তইতঅঅঅই’ কলতান। হিমেল হাওয়ায় ক্ষুদ্র লোমগুলো হয় খাড়া, হস্তপদ হিম বরফ, ঠোঁটদ্বয়ের কম্পন, কুঁকড়া শরীরের ঝাঁকুনী, তারপর শুকনো খড়ে দীপ্তঅগ্নি জ্বালিয়ে শীত দমনের বন্দোবস্ত। অল্পতেই গা-ঝিংগানো দেহে অনুভূত হয় উষ্ণতা। তারপর নবান্নের সূচনা। নতুন চালের ম্যারা পিঠা, চিতই পিঠা, খেজুরের গুড়ির ভাঁপা পিঠা ও ধোঁয়া-ওড়া গরম চা যেন সন্ধ্যাকে মাতিয়ে রাখে চমকপ্রদ আমেজ-উৎসবে। মুখের ধোঁয়ার সাথে চায়ের ধোঁয়ার মিশ্রণে কাপে চুমুক দেওয়ার অনুভূতিটা অনন্য। হরেক রকমের রংঢং, মৌজমাস্তিতে কেটে যায় গ্রামবাংলার প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য নবান্ন। খানিক পরে উঠানমাঠে শুরু নওজোয়ানদের ব্যাটমিন্টন। ব্যাটের ‘টাস-টুস’ গুঞ্জন যেন বিদ্রোহ করে রজনীর নীরবতার সাথে। এমন সার্থক, উপভোগ্য একটি দিবস কাটানো বাংলার গ্রাম ছাড়া আদৌও সম্ভব না। তাই তো শহরস্থ পল্লীপিপাসুরা শীতকালে ছুটে আসেন পল্লীপানে। শাওয়ারের পরিবর্তে নদী-পুকুরে সাঁতার কেটে গোসল করতে, মগজঘোলা করা শব্দদূষণ ছেড়ে একটু পাখির কিচিরমিচির শ্রবণে, উঁচু উঁচু দালানকোঠায় আটকা পড়া চোখে দিগন্ত দর্শনে, শীতাতপ ছেড়ে একটু মুক্তবাতাস আহরণে। কুয়াশা-ভেজা খেজুর-বৃক্ষে গাছিদের ওঠানামা, রস সংগ্রহ, ধোঁয়ামাখা ভোর-সকালে হাঁড়ির ভার কাঁধে অদূর হাটবাজারে গমন, কী এক অকৃত্রিম প্রশান্তি, প্রফুল্লতা মেলে হৃদয়জগতে। এ-দৃশ্যগুলোই স্থান পায় শিল্পীর রংতুলিতে, কবির ছন্দে, গায়কের কণ্ঠে। গ্রামীণ প্রকৃতির এমন অপূর্ব সৌন্দর্য আর কোথাও মিলবে না বাংলা ছাড়া। বাংলা একটি দেহ হলে পল্লী তার প্রাণ, আর চাষীরা হৃদপিণ্ড।
বাংলার ঐতিহ্য-সংস্কৃতি, কৃষকের হাসি, গ্রামীণ রূপবৈচিত্র্য থাকুক চির-অম্লান। আমার গ্রামবাংলাকে অনাবিল সৌন্দর্য আর মাধুর্য দিয়ে যিনি সৃজন করেছেন তাঁর তরে হৃদয়বিগলিত নিযুত কৃতজ্ঞতা।।
শিক্ষার্থী, বিয়ানীবাজার কামিল মাদরাসা, সিলেট
জানুয়ারি ২০২২