বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। একটি দ্রোহ ও চেতনার নাম। একটি উজ্জ্বল ও আলো বিচ্ছুরক সংগ্রামের নাম। যে নাম আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পেছনে মূল ভূমিকা যিনি রেখেছিলেন এবং যিনি ছিলেন এই স্বাধীন দেশের স্বপ্নদ্রষ্টা তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এজন্য নির্দ্বিধায় তাঁকে আমরা বলি বাংলাদেশের স্থপতি।
বঙ্গবন্ধুর জীবনের দিনগুলো যদি আমরা হিসেব করি তাহলে দেখতে পাই বেশিরভাগ সময় তিনি কাটিয়েছেন কারাগারে। দেশের জন্য সংগ্রাম করে তাঁকে বারবার কারাবরণ করতে হয়েছে এবং নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। কখনো কখনো মৃত্যুর মুখোমুখিও দাঁড়াতে হয়েছে। কিন্তু দেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর সেই মহান মানুষটি বেশিদিন বেঁচে থাকতে পারেননি; মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় ঘাতকদল নির্মমভাবে হত্যা করে।
মহান মানুষেরা মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকতে পারেন। বঙ্গবন্ধুও বেঁচে আছেন। তিনি বেঁচে আছেন দ্রোহে ও চেতনায়, বেঁচে আছেন কোটি বাঙালির হৃদয়ে। তাই বঙ্গবন্ধুকে আমরা আজও দেখতে পাই। এখনো টের পাই সরব জনতার মধ্যে তাঁর নীরব উপস্থিতি। তবে দুঃখ পাই, যখন তাঁকে নিগৃহীত হতে দেখি। উপেক্ষিত হতে, অপমানিত হতে দেখি তাঁর গড়া এ দেশের কিছু মানুষের কাছে।
স্বাধীনতার প্রায় ৪৮ বছর পর অনেকেই বঙ্গবন্ধুর কথা বলেন। সবাই তাঁকে নিয়ে গৌরব করেন। কিন্তু কেউ কেউ এ গৌরবের আড়ালে যে তাঁকে নিগ্রহ করে চলেছেন সে কথা কাউকে বলতে শোনি না। অথচ অনেক বেশি প্রয়োজন এ বিষয়ে কথা বলার। যারা তাঁকে অপমান করে প্রতিনিয়ত, তাঁদের বিরুদ্ধে কথা বলা, তাদের প্রতিবাদ করা অন্যতম কর্তব্য আমাদের।
কারা নিগ্রহ করে বঙ্গবন্ধুকে? কারা অপমান করে? এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেওয়া কঠিন। কারণ সবচেয়ে বেশি যাদের কাছে বঙ্গবন্ধুকে অপমানিত হতে দেখি, তারা মুখোশ পরে আছে। তারা তাঁর দলেরই লোক। তাঁরা নিজেদের বঙ্গবন্ধুর আদর্শে আদর্শবান বলে দাবী করে। কিন্তু বাস্তবে তাদের চরিত্র বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বিপরীত।
তারা বঙ্গবন্ধুর মতো পোশাক পরে। তাঁর মতো পাঞ্জাবি আর কালো কোট পরে। কিন্তু এ পোশাকে তাদের কদর্যতা কমই ঢাকা পড়ে। তারা বঙ্গবন্ধুর ছবি টানায় অফিসের দেয়ালে। সেই ছবির নিচে বসে নির্বিঘেœ ঘুষ গ্রহণ করে। পথে-ঘাটে তাঁর ছবি নিয়ে মিছিল করে, চাঁদাবাজি করে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুবার্ষিকীতে রাস্তার মোড়ে মোড়ে তাঁর ভাষণ বিকট আওয়াজে বাজিয়ে, কাঙালি ভোজ খাইয়ে তারা বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। এতটুকুই তাদের বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও চেতনার চর্চা।
বিজ্ঞ পাঠক খুব সহজেই আঁচ করতে পারছেন আমি কাদের কথা বলছি। আঁচ না করতে পারার কথা না। পথে-ঘাটে সব জায়গায় আজ এই ভন্ডদের অবাধ বিচরণ। অন্য দলের বিরোধিতা তো আছেই, নিজেদের দলের মধ্যেও কোন্দল ও হানাহানি করাই তাদের কাছে রাজনীতির সংজ্ঞা। একজন প্রকাশ্য সন্ত্রাসীর ছবির পাশে যখন এই প্রজন্মের কেউ বঙ্গবন্ধুর ছবি দেখবে তখন বর্তমান প্রজন্মের একটি শিশু কি তাঁকে চিনতে ভুল করবে না? একজন চাঁদাবাজ বা ঘুষখোর এবং প্রকাশ্য অপরাধীর পাশে তাঁর ছবি যে কতটা বেমানান ও অবমাননাকর তা শুধু তাঁরাই উপলব্ধি করতে পারেন যাঁরা তাঁকে প্রকৃত অর্থে ভালোবাসেন। যাঁরা সত্যি সত্যি বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করেন তারাই বুঝতে পারেন তঁাঁর অপমান।
বঙ্গবন্ধু ব্যাক্তি জীবনে কেমন ছিলেন তা নিয়ে আলোচনা হয়। আলোচনা হয় তাঁর সারাজীবনের ত্যাগ ও সংগ্রাম নিয়েও। কিন্তু একজন শাসক বা রাজনৈতিক হিসেবে বঙ্গবন্ধু কেমন ছিলেন অথবা দলীয় কর্মী ও রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি তাঁর কী নির্দেশ ছিল তা সবাই এড়িয়ে যায়। অথচ অন্যায়ের এই সয়লাবের সময় তাঁর সেসব বিষয়ে আলোচনা অতি প্রয়োজন।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের দেশে ফিরে আসেন। এরপর শুরু করেন তাঁর নতুন সংগ্রাম। বাংলাদেশ গড়ার সংগ্রাম। বিশ্বের দরবারে বাঙ্গলাদেশকে তুলে ধরার সংগ্রাম। মাত্র সাড়ে তিন বছরে তিনি যুদ্ধ বিধ্বস্ত, হত দরিদ্র একটি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যান বহুদূর। সত্যি বলতে কী, এ দেশকে নিয়ে তিনি যতটা ভাবতেন, তাঁর আগে বা পরে কেউ পারেনি তাঁর মতো করে ভাবতে।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে তাঁর দেওয়া বিভিন্ন ভাষণ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ নিয়ে তাঁর কর্মপন্থা ও চিন্তাধারা সম্পর্কে জানা যায়। সেই সময়ে তাঁর দলের লোকদের সবচেয়ে বেশি বলতেন আত্মশুদ্ধ হতে, দেশকে ভালোবাসতে।
তিনি বলতেন, দেশকে ভালো না বাসলে দেশের জন্য কাজ করা যায় না। এই চরম সত্য আমাদের দেশের বর্তমান কোনো রাজনীতিবিদই উপলব্ধি করতে পারেননি। তাই তো রডের টাকা পকেটে ভরে বাঁশ দিয়ে রাস্তা বানান অনেকে। জনদরদি নেতার মুখোশ পরে গরিবের টাকা আত্মসাৎ করে উঁচু গলায় জনগণের প্রতি ভালোবাসা বুলি ছুঁড়েন কেউ কেউ।
তৃতীয় বিশের দেশগুলো দুর্নীতি-আক্রান্ত। এর মধ্যে আমাদের রাষ্ট্র একাধিকবারের চ্যা¤িপয়ন। এ দেশে দুর্নীতি হয় সবার জানা। তাই দুর্নীতি দমন সম্ভব না হলেও দুর্নীতি রোধ তো সম্ভব। দুর্নীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে, দুর্নীতিবাজদের শাস্তি দিয়ে কিছুটা রোধ করা যেতে পারে। কিন্তু এ দেশে যে সরকারই ক্ষমতায় আসেন, তাঁরা নিজেদের নেতাকর্মীদের ভাবেন ধোয়া তুলসি পাতা। দেশে দুর্নীতি হয় তাঁরা স্বীকারই করতে চান না।
আজ থেকে ৪৭-৪৮ বছর আগেও এ দেশে দুর্নীতি হতো। তখনকার রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু তা জানতেন। কিন্তু এখনকার লোকদের মতো তিনি দুর্নীতির কথা অস্বীকার করতেন না। স্বীকার করতেন এবং দুর্নীতিবাজদের সাবধান করতেন।
১৯৭৫ সালে বঙ্গভবনের দরবার হলে দেওয়া এক ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘যে সার দিয়েছি তার থার্টি পারসেন্ট চুরি হয়ে গেছে। স্বীকার করেন? আমি স্বীকার করি। আমি মিথ্যা কথা বলতে পারব না। মিথ্যা বলে একদিনও দেশের হারাম প্রেসিডেন্ট থাকব না।’
হলফ করে বলতে পারি, বঙ্গবন্ধুর এই মনোভাব ও উপলব্ধির একশ’ ভাগের এক ভাগও যদি এ দেশের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের থাকত তাহলে দেশটা আজ অন্যরকম হতো।
বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন তাঁর লোকেরা দেশ গড়বে। তাই নিজের নেতা-কর্মীদের তিনি বার বার বলতেন শুদ্ধ হতে। ১৯৭৪ সালের আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক সম্মেলনে দেওয়া এক বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘দেশ শাসন করতে হলে নিঃস্বার্থ কর্মীর প্রয়োজন। হাওয়া কথায় চলে না। সেদিন ছাত্ররা আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। তাদের বলেছিলাম, আত্মসমালোচনা করো। মনে রেখো, আত্মসমালোচনা করতে না পারলে নিজেকে চিনতে পারবা না। তারপর আত্মসংযম করো, আর আত্মশুদ্ধি করো। তাহলেই দেশের মঙ্গল করতে পারবা।’
আজকের ছাত্রনেতাদের দিকে যদি তাকাই তাহলে বঙ্গবন্ধুর সেই কথাগুলোকে রূপকথার গল্পের মতো মনে হয়। তাঁর দলের ছাত্রনেতারা এখন আত্মপ্রশংসা করে শেষ করতে পারেন না। আত্মশুদ্ধি আর আত্মসংযম তো বহু দূরের কথা।
সেদিন আওয়ামী লীগের কর্মীদের তিনি বলেছিলেন, ‘সত্যি কথা বলতে কী, আমাদের একটা কথা মনে রাখা দরকার। আওয়ামী লীগ-কর্মীরা, কোথায় যেন গোড়ায় একটু গলদ রয়ে গেছে। মানুষ অর্থের জন্য এত পাগল হয়েছে কেন? কীভাবে শুধু টাকা কামাই করবেÑএ চিন্তায়ই মগ্ন থাকে তারা প্রতিটা মুহূর্ত।’
স্মৃতি থেকে মাত্র কয়েকটি ভাষণের উদ্ধৃতি দিলাম। তাঁর ভাষণসমগ্রে এমন বক্তব্যের হাজারো উদাহরণ পাওয়া যাবে। এমন দরদপূর্ণ সাবধানী বাণীর পরও কীভাবে তাঁর দলের লোকেরা পথভ্রষ্ট হয় তা ভাবলে অবাক লাগে। তিক্ত হলেও সত্য, বঙ্গবন্ধুর আদর্শবান দল এখন চাঁদাবাজ, সন্ত্রাস আর ঘুষখোরদের দলে পরিণত হয়েছে। তারা বঙ্গবন্ধুর নামে লুটপাট করে অবলীলায়। আর সেই লুটপাটকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাস্তবায়ন বলে অভিহিত করে তা জায়েজ করার চেষ্টা করে।
এদের কাছে বঙ্গবন্ধু আজ সত্যিই অসহায়। এদের হাতে এই মহান নেতা আজ নিগৃহীত।
লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আগস্ট ২০১৮